বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ে ভাটা, কমছে ডলারের রিজার্ভ ও রপ্তানি আয়
2022.11.02
ঢাকা

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস প্রবাসী আয়ে ভাটা পড়ায় কমে যাচ্ছে দেশের ডলারের রিজার্ভ। এর পাশাপাশি কমেছে রপ্তানি আয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যে এসব চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় কমে যাওয়ায় দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সরকারি হিসেবে, ১ নভেম্বর বাংলাদেশে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলার যা গত বছর জুনে ছিল প্রায় ৪৬ বিলিয়ন। অর্থাৎ গত ১৬ মাসে রিজার্ভ কমেছে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
তবে বাংলাদেশ সফররত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রতিনিধিদের মতে, বিভিন্ন খাতের প্রতিশ্রুত খরচ বাদ দিলে বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে কমপক্ষে চার মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
আইএমএফের কাছে গত জুলাইয়ে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছিল বাংলাদেশ। সেই ঋণ নিয়ে আলোচনা করতে সংস্থাটির ১০ সদস্যের একটি দল গত ২৬ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশ সফরে রয়েছে।
প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স কমে আসার মূল কারণ “হুন্ডির পরিমাণ বেড়ে যাওয়া” বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, “দেশে বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ৩৬ বিলিয়ন ডলার বলা হলেও আইএমএফ প্রতিনিধিরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রকৃত মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার।”
কোনো দেশের হাতে তিন মাসের আমদানি খরচ মেটানোর মতো রিজার্ভ থাকলেই ‘নিরাপদ’ বলে ধরে নেয়া হয়, জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের আমদানি খরচ মেটানো গেলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসা “ভালো লক্ষ্মণ নয়।”
“বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বলছে, আমদানির খরচ বেশি দেখিয়ে এবং রপ্তানির খরচ কম দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, আগামী নির্বাচন ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হুন্ডি-হাওলার মাধ্যমে টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এটি বন্ধ করতে হবে,” বলেন ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
কমছে প্রবাসী আয়
সদ্য সমাপ্ত অক্টোবর মাসে ১৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা অর্থাৎ এক দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত আট মাসের মধ্যে সবচে কম। এক বছর আগে ২০২১ সালের অক্টোবরে রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৬৫ কোটি ডলার।
করোনাভাইরাস মহামারি কমে আসায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বাজার উন্মুক্ত হবার পর প্রায় ১৫ লাখ নতুন কর্মী বিদেশে গেলেও “রেমিটেন্সে গতি দেখা যাচ্ছে না,” বলে বুধবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
তাঁর মতে, “রেমিটেন্সের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ হুন্ডি ও অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে অর্থ পাঠানো। এর কারণ হুন্ডি এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের ব্যাপক পার্থক্য।”
হুন্ডি ও অন্যান্য অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমে বর্তমানে প্রতি ডলারের দাম ১১৫ টাকার মতো হলেও ব্যাংকিং চ্যানেলে তা ১০৭ টাকা জানিয়ে তিনি বলেন, হুন্ডিতে ঝুঁকি থাকলেও এই কারণেই অনেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে আগ্রহী।
“ব্যাংকিং ও অনানুষ্ঠানিক মাধ্যমের বিনিময় হারের মধ্যে এক টাকার ব্যবধান থাকলে হুন্ডি কমে আসবে,” বলে মনে করেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।

কমেছে রপ্তানি
বুধবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী চলতি বছর সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমেছে।
জুলাই থেকে অক্টোবর এই চার মাস রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১৭ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে সরকার। তবে রপ্তানি হয়েছে ১৬ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার।
সরকার অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল পাঁচ বিলিয়ন ডলার। তবে আয় হয়েছে চার দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বরেও রপ্তানি আয় কমেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে, ২০২১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় ছিল প্রায় চার হাজার ৮৭২ বিলিয়ন টাকা (৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি) এবং আমদানি ছিল নয় হাজার ১৭৬ বিলিয়ন টাকা (৯১ বিলিয়ন ডলারের বেশি)।
আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান ছিল চার হাজার ৩০৪ বিলিয়ন টাকা যা বর্তমান বিনিময় হারে মার্কিন ডলারে দাঁড়ায় ৪৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
আমদানি নির্ভর বাংলাদেশে রপ্তানি আয় ও আমদানি ব্যয়ের মধ্যে যে পার্থক্য থাকে তা পূরণ হয় প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট চলমান বৈশ্বিক মন্দা, ডলারের উচ্চ দর, মুদ্রাস্ফীতি ইত্যাদির কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের শতকরা প্রায় ৮৪ ভাগ আসে তৈরি পোশাক থেকে।
তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারদের সংগঠন বিজিএমইএ’র মিডিয়া মুখপাত্র শোভন ইসলাম শাওন বুধবার বেনারকে বলেন, রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ বৈশ্বিক মন্দা। এই মন্দার প্রভাব বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের মূল বাজার ইউরোপ ও আমেরিকায় বেশি দেখা যাচ্ছে। সেখানে তেলের দাম বেড়ে গেছে এবং মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সেখানে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমেছে এবং এর প্রভাবে সেখানে পোশাক আমদানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।