মূল্যস্ফীতির চাপে সঞ্চয় ভাঙছে মানুষ

রিয়াদ হোসেন
2023.12.07
ঢাকা
মূল্যস্ফীতির চাপে সঞ্চয় ভাঙছে মানুষ রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় সরকারের ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্র থেকে স্বল্পমূল্যে পণ্য সংগ্রহ করছেন ক্রেতারা। ৪ ডিসেম্বর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান হারুন খরচ কুলাতে না পেরে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পাঁচ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র তুলে ফেলেছেন।

বেনারের সঙ্গে আলাপকালে বৃহস্পতিবার এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী জানান, “এটুকু ছাড়া আর কোনো সঞ্চয় ছিল না। কিন্তু ব্যবসাও ভালো যাচ্ছে না। তার ওপর ক্রমাগত খরচ বাড়তে থাকা, বাচ্চার লেখাপড়ার খরচ মিলিয়ে সামাল দিতে পারছিলাম না বলেই চার মাস আগে সঞ্চয়পত্র ভাঙাতে হয়েছে।”

রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আহমেদুর রহমান (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) মাস দুয়েক আগে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা ১০ লাখ টাকা তুলেছেন। নিজের আয়ে মায়ের চিকিৎসা আর সংসারের অন্যান্য খরচ যোগাতে না পেরে তিনি ওই সঞ্চয় ভাঙতে বাধ্য হন।

বেনারকে তিনি বলেন, “খরচে কুলাতে পারছিলাম না, এজন্য ভাঙাতে হয়েছে। আবার কখনো টাকা হাতে আসলে সঞ্চয়পত্র কিনব।”

কেবল এই দুজন নন, সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া মানুষের সংখ্যাটা বেশ বড়ো। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তথ্যেও এর প্রমাণ মিলেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে যত টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা হয়েছে, ভাঙা হয়েছে তার চেয়ে ২ হাজার ৩০৫ কোটি টাকা বেশি।

এর আগে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের চেয়ে ৩ হাজার ২৯৬ কোটি বেশি টাকা ভাঙানো হয়েছে, যা ছিল বিগত ১০ বছরের মধ্যে বেশি।

২০২১-২২ অর্থবছরেও এ খাতে নিট বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। মোট বিনিয়োগ থেকে তুলে নেওয়া অর্থ বাদ দেওয়ার পর অবশিষ্ট থাকা অর্থকে নিট বিনিয়োগ বলা হয়।

কারণ, মূল্যস্ফীতি

বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল্যস্ফীতি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষ উপায়ন্তর না দেখে সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানত ভাঙাচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। যার কারণে যাদের বাড়তি আয় নেই, তারা সঞ্চয়পত্র ভাঙ্গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে।”

তবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার অন্য কারণও থাকতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সরকারকে মূল্যস্ফীতি কমানোর দিকে নজর দিতে হবে।”

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ “সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতি।”

তাঁর মতে, এর ফলে চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য পূরণ হবে না।

ফলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হবে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে, যা কর্মসংস্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে,” বলেন এই অর্থনীতিবিদ।

প্রসঙ্গত, সঞ্চয়পত্রে সাধারণ মানুষ বিনিয়োগ করলেও এটি সরকারের জন্য ঋণ। চলতি অর্থবছর সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা।

গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করে আসছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ শতাংশের কাছাকাছি, যা ছিল আগের এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। নভেম্বরে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও সাড়ে নয় শতাংশের ওপরে রয়েছে।

মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে মানুষের পকেটে টান পড়বে। এমন পরিস্থিতিতে তারা সঞ্চয় ভাঙাবে বা নতুন বিনিয়োগ করবে না-এটিই স্বাভাবিক,” অর্থনীতিবিদদের সাথে একমত পোষণ করে বেনারকে বলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান।

তাঁর আশা, মূল্যস্ফীতি চলতি মাসে কমে আসবে এবং আগামী মাসগুলোতে আরো কমবে।

কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমতে পারে, তার ব্যাখ্যা দিয়ে বেনারকে তিনি বলেন, “আমন ধান উঠতে শুরু করেছে। বাজারে শাক-সবজির দাম কমছে। মাংস ও ডিমের দামও কমতির দিকে। ফলে মূল্যস্ফীতি আগামী মাসগুলোতে আগের জায়গায় (ছয় শতাংশের নিচে) আসবে বলে আশা করছি।”

তখন মানুষ আবার নতুন করে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবে,” বলেন মন্ত্রী।

কড়াকড়িও বিক্রি কমার অন্যতম কারণ

বাংলাদেশে ব্যাংক, ডাকঘর ও সঞ্চয় ব্যুরো’র মাধ্যমে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ এবং মেয়াদপূর্তি বা মেয়াদের আগে টাকা উত্তোলন করা যায়।

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারীদের সরকার নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে সুদ পরিশোধ করে। তবে যে মেয়াদের জন্য সঞ্চয়পত্র কেনা হয়, তার আগে কেউ তা ভাঙালে তিনি সুদের অর্থ কম পান।

দেশে মূলত চার ধরনের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা যায়। এগুলো হলো; পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র, পরিবার সঞ্চয়পত্র ও পেনশনার সঞ্চয়পত্র।

সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই চারটি খাতে সূদের হার ১১ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের কড়াকড়ি আরোপও বিনিয়োগ কমে যাবার অন্যতম কারণ বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, “এখন সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) দিতে হয়, ব্যাংকের মাধ্যমে কিনতে হয়, আবার টাকা জমা হয় ব্যাংকে। কতজনের ব্যাংক হিসাব বা টিআইএন আছে?”

কর বিভাগ থেকেও নানা ধরনের কড়াকড়ির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনা করে এত কড়াকড়ি আরোপ করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।

পাশাপাশি, বিনিয়োগ করতে হলে আয়কর সনদ দিতে হয় উল্লেখ করে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, “এটি কয়জনের পক্ষে দেওয়া সম্ভব?”

এছাড়া সম্প্রতি ব্যাংকগুলোতে আমানতের সূদের হার বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আগে ব্যাংকের সূদের হার ও সঞ্চয়পত্রের মধ্যে ভালো ব্যবধান ছিল, যে কারণে মানুষ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হতো। কিন্তু এখন সেই ব্যবধান অনেক কমে গেছে।

যেহেতু ব্যাংকে সূদের হার বেড়েছে, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আকর্ষণে এখানেও সূদের হার বাড়ানো উচিত,” যোগ করেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।