আইএমএফের শর্তমতে রিজার্ভ সংরক্ষণ হবে কঠিন চ্যালেঞ্জ
2023.05.08
ঢাকা

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুযায়ী সরকার কিছু পদক্ষেপ নিলেও রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমতির দিতে থাকায় আগামী জুনের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার রাখা কঠিন হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকায় বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, “জুনের মধ্যে রিজার্ভের লক্ষ্য অর্জন করা কঠিন হবে। মাত্র দুই মাসের কম সময় আছে।”
আইএমএফ-এর একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সরকারের বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক শেষে রোববার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের রিজার্ভ চাপে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে।
“ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক আর্থিক খাতের অস্থিরতা বাড়তে থাকা ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোতে প্রবৃদ্ধির শ্লথগতি—এই তিন চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও স্থানীয় মুদ্রা টাকার ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে,” বিবৃতিতে বলেন আইএমএফ স্টাফ মিশনের প্রধান রাহুল আনন্দ।
গত ৩০ জানুয়ারি বৈশ্বিক ঋণদাতা সংস্থাটি বাংলাদেশকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে, যা সাড়ে তিন বছরে দেওয়া হবে। অনুমোদনের পর ফেব্রুয়ারির শুরুতেই ঋণের প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে আইএমএফ। চলতি বছরের শেষ দিকে ছাড় হতে পারে দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ।
তবে ঋণ দেওয়ার সময় সংস্থাটি ছোট-বড়ো ৩০টির বেশি প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের (শর্ত) সময়সীমাও ঠিক করে দিয়েছে। সাত কিস্তির ঋণের প্রতিটি কিস্তি ছাড় করার আগে তারা এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবে।
এর মধ্যে একটি শর্ত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে মিল রেখে রিজার্ভের হিসাব করা, যা বিপিএম সিক্স নামে পরিচিত। সে ক্ষেত্রে রিজার্ভের অর্থ দিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) গঠন, বিদেশে বিভিন্ন ধরনের বন্ড, মুদ্রা ও স্বর্ণে বিনিয়োগ, শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ঋণের অর্থসহ আরও কিছু তহবিল হিসাবে আনা যাবে না।
গত এক বছরের ব্যবধানে ৪৪ বিলিয়ন ডলার থেকে রিজার্ভ ক্রমাগত কমছে। সর্বশেষ সোমবার রিজার্ভ নেমে এসেছে ২৯ বিলিয়ন ডলারে।
এ অবস্থায় বিপিএম সিক্স মানদণ্ড অনুযায়ী নিট রিজার্ভ আগামী জুনের মধ্যে কমপক্ষে ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার রাখার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বা বিপিএম সিক্স অনুযায়ী, নিট রিজার্ভের পরিমাণ কত, বাংলাদেশ ব্যাংকে এমন কোনো তথ্য নেই। বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও নিট রিজার্ভের পরিমাণ (বিপিএম সিক্স অনুযায়ী) জানাতে পারেননি বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক।
তবে গত বছরের নভেম্বরে আইএমএফের মিশনের সঙ্গে সভা শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ইডিএফ ও অন্যান্য তহবিল বাদ দিলে মোট রিজার্ভ থেকে ৮ বিলিয়ন ডলার কমবে।
অবশ্য সম্প্রতি ইডিএফের আকার ছোট করায় রিজার্ভের ওই অর্থ যোগ হয়েছে। তা সত্ত্বেও বর্তমানে ২৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়েছে নিট রিজার্ভ। এর মধ্যে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমতির দিকে।
‘সমস্যা সহসা কাটবে না’
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বেনারকে বলেন, “রপ্তানি ও প্রবাসী আয় কমছে। সব মিলিয়ে রিজার্ভের সমস্যা সহসা কাটবে না।”
তাঁর মতে, আইএমএফের লক্ষ্য অনুযায়ী জুনের মধ্যে রিজার্ভের পরিমাণ “২৪ বিলিয়ন ডলারের উপরে আনা কঠিন হয়ে যাবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, গত এপ্রিলে রপ্তানি আয় কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ আর প্রবাসী আয় কমেছে ১৬ শতাংশ। আগামী মাসগুলোতেও আশার কথা শোনাতে পারছেন না রপ্তানিকারকরা।
আইএমএফের সাবেক কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, “রিজার্ভ ও রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।”
প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক সংবাদ সম্মেলনে আশা প্রকাশ করেছিলেন, আগামী মাসগুলোতে রিজার্ভ আরও শক্তিশালী হবে।
যোগাযোগ করা হলে বেনারকে তিনি বলেন, “বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে (ঋণের)। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের কিছু ঋণের অর্থ পাওয়া যাবে। এছাড়া জাপান, বিশ্বব্যাংক, এডিবি’র (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) সঙ্গে ঋণচুক্তি হচ্ছে। হয়তো এগুলো থেকেও কিছু কিছু আসবে।”
“আমরা মনে করছি, এটা কাছাকাছি থাকবে। সব যদি ইতিবাচকভাবে কাজ করে তাহলে আমরা অর্জন করে ফেলতে পারব,” যোগ করেন তিনি।
‘সংস্কারে তেমন অগ্রগতি হয়নি’
আইএমএফের সংস্কার পরিকল্পনা অনুযায়ী, জিডিপিতে করের অবদান (ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও) শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া ভর্তুকি যৌক্তিক করা (কমিয়ে আনা), বার্ষিক প্রতিবেদনে খেলাপি ঋণের পরিমাণসহ ঋণ পুনঃতফসিলের তথ্য প্রকাশ, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংসদে উত্থাপন করা, আমানত ও ঋণের সুদ হার বাজারভিত্তিক করা, মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করাসহ আরও কিছু বিষয়—যা চলতি বছরের প্রথম পর্যালোচনার আগেই করতে হবে।
সরকার গত বছরের আগস্টে আমদানিকৃত জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে ১৫ শতাংশ। আর শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে দ্বিগুণের বেশি। ফলে এসব খাতে ভর্তুকি অনেক কমে এসেছে। ব্যাংক কোম্পানি আইন মন্ত্রিসভায় পাস হয়েছে।
তবে ব্যাংক খাতে অনেক সংস্কারই হয়নি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই বিষয়ে ড. রাজ্জাক বলেন, “এখন পর্যন্ত সংস্কারের তেমন কিছুই হয়নি। রিজার্ভ গণনা পদ্ধতি ঠিক হয়নি, একক বিনিময় হার হয়নি, সুদহারও বাজারভিত্তিক হয়নি।”
এ বিষয়ে সহমত পোষণ করেন ড. আহসান এইচ মনসুর।
বাজারভিত্তিক সুদহার ও বিনিময় হারের বিষয়ে রোববার সংবাদ সম্মেলনে মেজবাউল হক বলেন, আগামী জুনে মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে জানাবে, জুলাই থেকে তা কার্যকর হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রার একক বিনিময় হার প্রায় অর্জিত হয়ে গেছে বলেও জানান তিনি। তিনি আরও জানিয়েছেন, কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও আইএমএফ বিভিন্ন যৌথ কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতির বিষয়ে সন্তুষ্ট।
সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে: আইএমএফ
আইএমএফের প্রতিনিধি দল ১২ দিনের সফরে বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও অর্থ মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, রাজস্ব বোর্ডসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে।
এসব আলোচনায় সংস্কারের পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রগতির বিষয়ে জানতে বেনারের পক্ষ থেকে ইমেইল পাঠানো হয়েছিল। তার জবাবে মিশন প্রধান রাহুল আনন্দকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, “ঋণ কর্মসূচির প্রথম পর্যালোচনা চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে হবে এবং তখন অগ্রগতির মূল্যায়ন করা হবে।”
এতে আরও বলা হয়, “সরকার কর্মসূচির উদ্দেশ্য পূরণে পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির মাধ্যমে উদ্দেশ্যহীন ভর্তুকি কমানো, বাজারভিত্তিক (মুদ্রার) বিনিময় হারের দিকে যাচ্ছে।”