বিশ্লেষণ: অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে চায় সরকার
2023.05.01
ঢাকা ও ওয়াশিংটন ডিসি
বিশ্লেষকদের মতে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থনৈতিক সংকট বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থাকে নাজুক করে তুলতে পারে, এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াশিংটন সফর তাৎপর্যপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে দেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন অংশীদার বিশ্বব্যাংকের এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়ন সহযোগীদের বিনিয়োগ অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
এর দুই দিন আগে প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎ করেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে।
উল্লেখ্য, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর পরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হতে থাকলে ডলারের সংকট দেখা দেয়। সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু উদ্যোগ নিলেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে যায় ব্যাপক হারে।
এর মধ্যে আইএমএফ গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশের জন্য ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন করে। আইএমএফ-এর এই ঋণকে কিছুটা স্বস্তির বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাসস-এর সংবাদ অনুযায়ী, গত ২৯ এপ্রিল সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে বৈঠকের পরে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা জানান।
এদিকে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নশীল দেশ হয়ে ওঠার পথে বাংলাদেশের মসৃণ উত্তরণ, পরবর্তীতে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উত্তরণ লাভ এবং এর ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা বৃদ্ধি করার আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে জাতিসংঘের এলডিসি মর্যাদা থেকে মসৃণ ও টেকসই উত্তরণ লাভের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক সদর দপ্তরের প্রিস্টন অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত “বিশ্বব্যাংক-বাংলাদেশ অংশীদারিত্বের ৫০ বছরের প্রতিফলন” শীর্ষক পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন (আড়াই বিলিয়ন) ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের কাছে পদ্মা বহুমুখী সেতুর একটি ছবি তুলে দেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “আমি আশা করব বিশ্বব্যাংক আগামী বছরগুলোতে আমাদের ভৌত ও সামাজিক উভয় খাতে মেগা-প্রকল্পগুলোতে সম্পৃক্ত হবে।”
এ উপলক্ষে সোমবার বিশ্বব্যাংকের এক বিবৃতিতে জানানো হয় বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব লাখো মানুষের দারিদ্রমুক্তি ও দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
‘অর্থনৈতিক সহায়তা ও সমর্থন দুটোই প্রয়োজন’
গত ২৫ এপ্রিল থেকে থেকে শুরু হওয়া ত্রিদেশীয় সফরে জাপান ও যুক্তরাজ্য সফরের মাঝখানে বর্তমানে ছয়দিনের সফরে যুক্তরাষ্ট্র রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার এই সফরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কোনো কর্মকর্তা বা রাজনীতিকের সাথে সাক্ষাৎ বা বৈঠকের কোনো কর্মসূচি নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে শেখ হাসিনা সরকার যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের ব্যাপক সমালোচনার মুখে রয়েছে। গত মাসে সংসদে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা।
তবে প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুটো দিকই রয়েছে বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রিয়াজ।
“বিশ্বব্যাংকের সাথে বৈঠকে তিনি মূলত অর্থনৈতিক সহায়তার সন্ধান করছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনীতির দিক থেকে খুবই সংকটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে,” সোমবার বেনারকে বলেন আলী রিয়াজ।
তাঁর মতে, রাজনৈতিক কারণটি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর কঠোরতার কারণে জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনসহ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে হাসিনা সরকারের সমালোচনার সাথে সম্পর্কিত।
গত মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ওপর হুমকি, আক্রমণসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মানবাধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সময় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
এদিকে গত মাসের শুরুতে সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘অগণতান্ত্রিক’ শক্তিকে ক্ষমতায় আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে বলে দেশটির কড়া সমালোচনা করেন। পাশাপাশি দেশের দুর্নীতিবাজদের সহায়তার জন্যও যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেন।
“এখন তিনি (শেখ হাসিনা) দেখানোর চেষ্টা করছেন যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তাঁর প্রতি সহযোগিতার মনোভাব রয়েছে। আর তখন (যুক্তরাষ্ট্রে সমালোচনার সময়) তাঁর সমর্থকদের তিনি তাঁর শক্ত মনোভাব দেখিয়েছেন,” বলেন আলী রিয়াজ।
তিনি বলেন, “তবে একই সাথে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করা তাঁর জন্য খুবই কঠিন হবে। তিনি দেখতে চাইবেন, প্রভাবশালীদের কাছে তাঁর আসন্ন নির্বাচন বৈধ বলে গণ্য হোক, কারণ তাঁর অর্থনৈতিক সহায়তা ও সমর্থন দুটোই প্রয়োজন।”
নির্বাচনের জন্য ‘অর্থনীতিক স্থিতিশীলতা খুব জরুরি’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানের মতে, “গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, নির্বাচন ও মানবাধিকার অনেকটা অগ্রাহ্য করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থাকার পেছনে সবচেয়ে বড়ো নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল অর্থনৈতিক মজবুত ভিত। হঠাৎ করে সেটি দুর্বল হয়ে পড়ায় আগামী নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়েছে ক্ষমতাসীনদের মনে।
“এই কারণেই বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে তৎপর হয়েছে সরকার। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ সরকারের একটাই চাওয়া হচ্ছে, যে কোনোভাবে জনগণকে ম্যানেজ করে আবারও ক্ষমতায় আসা। সেটার জন্য অর্থনীতিক স্থিতিশীলতা খুব জরুরি,” বলেন হাফিজ উদ্দিন।
এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “অর্থনৈতিক সংকট রাজনৈতিক অবস্থাকে নাজুক করে তুলতে পারে। যদিও রাজনৈতিক সংকট অর্থনীতিকে নাজুক করছে। তাই সরকারের বিদেশি ঋণ প্রয়োজন। সেটা আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক ছাড়া ভালোভাবে পাওয়া কোথাও সম্ভব নয়।”
অর্থনীতিবিদ ও আইএমএফ-এর সাবেক কর্মকর্তা ড. আহসান এইচ মনসুর বেনারকে বলেন, “অর্থনীতি যদি ঠিক হয়, তাহলে তা সরকারের জন্য পরবর্তী নির্বাচনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
“ইলেকশনের আগে প্রধানমন্ত্রীর এই সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত,” বলেন তিনি।
অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ড. এম মাশরুর রিয়াজ বেনারকে বলেন, “দেশের রিজার্ভ কমে যাওয়া যেমন সরকারের দুর্বলতা হিসেবে দেখাবে, জীবনযাত্রার ব্যয় যেটা ইতোমধ্যে বেড়েছে, সেটা আরও বেড়ে যেতে পারে। তখন জনজীবনে অসন্তোষ; সেটাও চলে আসতে পারে।”
প্রধানমন্ত্রীর আলোচনায় উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে অর্থায়ন পাওয়া সহজ হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অর্থনীতির সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ব্যালেন্স অব পেমেন্টে অস্থিরতা। এটি স্থিতিশীল করতে হলে আইএমএফ যে সাপোর্ট দিয়েছে (৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি), তার বাইরে আরও বাজেট সাপোর্ট লাগবে। সেটা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ভিজিট করছেন, যা পাওয়ার সম্ভাবনা এগিয়ে নিতে সহায়ক হবে।”
প্রসঙ্গত, আগামী জুন মাসেই সংসদে পরবর্তী অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপনের কথা রয়েছে।
তিক্ততা মেটাতে সহায়ক হবে
বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে ২০১২ সালে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি থেকে সংস্থাটির সরে যাওয়ার পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের যে তিক্ততা তৈরি হয়েছিল, তা প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের মধ্য দিয়ে কেটে যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সোমবার ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর কথায় এমন ইঙ্গিত মিলেছে। সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস-এর সংবাদে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তার সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আরও অধিক অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে চাচ্ছে।
এই বিষয়ে আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বাংলাদেশের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে (বিশ্বব্যাংকের), সেটা অনেকখানিই সহজ হবে (প্রধানমন্ত্রীর) এই সফরের মধ্য দিয়ে।”
সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় বিশ্বব্যাংকের কড়া সমালোচনা করা হলেও বাংলাদেশকে সংস্থাটির ঋণদানে কোনো প্রভাব পড়েনি বলে মন্তব্য করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক সিনিয়র ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংকের আওতাধীন ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আইডিএ) একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বড়ো ঋণপ্রাপ্ত দেশ। এই ঋণের বড় অংশই এসেছে পদ্মা সেতু সংক্রান্ত ইস্যুর পরে।”
প্রসঙ্গত, আইডিএ আওতায় বাংলাদেশের চলমান ঋণের পরিমাণ ১৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে সংস্থাটির প্রতিশ্রুত ঋণের পরিমাণ ৩৮ বিলিয়ন ডলার।