ঈদযাত্রায় ভোগান্তি কম, কমেনি দুর্ঘটনা
2023.04.20
ঢাকা
বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরে ঘরমুখো মানুষের সড়ক যাত্রায় স্বস্তি থাকলেও বৃহস্পতিবার একের পর এক দুর্ঘটনার খবর এসেছে।
মূলত বুধবার থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে উৎসব করতে রাজধানী ঢাকা ছাড়া শুরু করেন। বৃহস্পতিবার একাধিক পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১০জন প্রাণ হারিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্র।
অন্যান্য বছরগুলোতে ঈদযাত্রায় সড়কে যানজটের ভোগান্তি থাকলেও এবার তা খুব একটা হয়নি। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের।
বৃহস্পতিবার সকালে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর এলাকায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে ৪ জন নিহত ও ১৯ জন আহত হন বলে বেনারকে জানান হাঁসাড়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোল্লা জাকির হোসেন।
শরীয়তপুরগামী এক যাত্রীবাহী বাস একটি ট্রাককে ধাক্কা দিলে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি।‘
অপরদিকে দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার উচিৎপুরে বৃহস্পতিবার একটি বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে থ্রি-হুইলারের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় দুই শিশুসহ একই পরিবারের চারজন নিহত ও দুইজন আহত হয়েছেন বলে বেনারকে জানান চিরিরবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান আসাদ।
নিহতদের মধ্যে দুটি শিশুও রয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া একই দিন নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলায় মোটরসাইকেল বিদ্যুতের খুঁটিতে ধাক্কা লেগে এক কলেজ ছাত্র ও সিলেটের জালালাবাদ এলাকায় বৃহস্পতিবার ট্রাক- মোটরসাইকেল সংঘর্ষে এক কিশোর নিহত ও দুইজন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।
ঈদের ছুটিতে দুর্ঘটনা ‘কয়েক গুণ’ বেড়ে যায়
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েক বছর ধরে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম অনুসারে, দেশে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সড়ক দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের মধ্যে মারা যাওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ২০১৯ সালে এক হাজার ২৩৪ জন, ২০২২ সালে এক হাজার ৩৭৭ জন, ২০২১ সালে এক হাজার ৭৭৬ জন, ২০২২ সালে দুই হাজার ৭৭ জন এবং চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৪৬৮ জন।
এই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে ২৭ হাজার ৮৮০ জন রোগী ভর্তি হলেও চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই এই সংখ্যা আট হাজার ৭৮৪ জন।
২০১৯ সাল থেকে এই পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
অপরদিকে, গত বছর ঈদুল আজহার আগে ও পরে ভ্রমণের সময় মাত্র ১৫ দিনে ৩১৯টি দুর্ঘটনায় সড়কে ৩৯৮ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
এটি ছিলে সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হিসেবে গত ৭ বছরে সবচেয়ে বেশি।
সড়কে এই বিপুল সংখ্যক দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বেনারকে বলেন, বছরজুড়েই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে, কিন্তু সেটা দুই ঈদের ছুটিতে কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
ঈদের সময় দুর্ঘটনা বাড়ার পেছনে সরকার, পরিবহণ মালিক-শ্রমিক ও যাত্রীদের নানা গাফলতি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ঈদের সময় দেখা যায় প্রতিদিনই ৪০ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ে। কিন্তু দেশে পরিবহণ খাতের সক্ষমতা রয়েছে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ১৮ লাখ। এর ফলে সড়কে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।"
ভয় নিয়েই বাড়ি ফিরছে মানুষ
সড়কে মৃত্যুর খবরের মধ্যেও থেমে নেই মানুষের বাড়ি ফেরার প্রাণান্তকর চেষ্টা। সড়ক পথ, নৌপথ এবং রেলপথে প্রতিদিনই বাড়ি ফিরছে লাখ লাখ মানুষ।
মোবাইল অপারেটরদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে জানিয়েছেন, ঈদুল ফিতরের ছুটিতে বুধবার ঢাকা ছেড়েছেন ১৬ লাখ ৭২ হাজার ৬৪৫টি মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহারকারী।
সিমের এই সংখ্যা দিয়ে ঠিক কত মানুষ ঢাকা ছেড়েছেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, একজন মানুষ একাধিক সিমও ব্যবহার করতে পারেন। আবার বহু শিশু, বয়স্ক ও দরিদ্র মানুষের হাতে মোবাইল ফোন নেই।
তবে এই পরিসংখ্যান থেকে ঘরমুখী মানুষের ঢল সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।
রাজধানীর সায়দাবাদ এলাকা থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আরাফাতুল ইসলাম।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তিনি বেনারকে বলেন, সড়কে দুর্ঘটনাগুলো মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাচ্চারা দাদা-দাদীর সঙ্গে ঈদ করতে চায়। তাই যেতেই হচ্ছে।
আরাফাতুল জানান, অন্য বছরের তুলনায় গাড়ি পেতে তেমন একটা ভোগান্তি হচ্ছে না। আগেই বাড়ি ফেরা পরিবার সদস্যদের কাছে জেনেছেন মহাসড়কেও খুব একটা ভোগান্তি নেই।
বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুর মহানগরীর চন্দ্রা চৌরাস্তা এলাকা পরিদর্শন শেষে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সারাদেশে বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের পাশাপাশি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও কাজ করছেন।
পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল শুরু
দীর্ঘদিন পর পদ্মা সেতুতে আবার মোটরসাইকেল চলাচল শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে।
গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরদিন যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। তারপর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। মোটরসাইকেল আরোহীরা টোল প্লাজার ছয়টি বুথের সামনে ঢুকে পড়েন। টোল প্লাজার সামনে থেকে সংযোগ সড়কে অন্তত দুই কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়।
পরদিন এক গণবিজ্ঞপ্তিতে ২৭ জুন সকাল ৬টা থেকে পুনরায় আদেশ না দেয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে এ গণবিজ্ঞপ্তি নিয়ে রিট করা হয়। পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ কেন বেআইনি হবে না, সে বিষয়ে রুল চাওয়া হয়। যদিও রিটটি সম্প্রতি খারিজ হয়েছে।
ঈদ সামনে রেখে বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা থেকে কিছু শর্ত সাপেক্ষে পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল করছে।
মোটরসাইকেল চালকদের উদ্দেশ করে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “আশা করি সবাই নিয়ম মেনে চলাচল করবেন। নিয়ম বহির্ভূতভাবে চালানোর কারণে অন্যান্য যানবাহনের অসুবিধা হলে আবারও পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করা হবে।”
ঈদযাত্রাকে কেন্দ্র করে পদ্মা সেতুর টোল প্লাজা পরিদর্শন করে এ কথা বলেন তিনি।
পদ্মা সেতুর অতিরিক্ত পরিচালক আমির হায়দার চৌধুরী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দুপুর ২টা পর্যন্ত চার হাজার ৮৪৯টি মোটরসাইকেল পারাপার হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে ৪ হাজার ৫১৬টি মোটরসাইকেল এবং জাজিরা প্রান্ত দিয়ে ৩৩৩টি মোটরসাইকেল সেতুতে প্রবেশ করেছে।
একমাস রোজা রাখার পর শুক্রবার সন্ধ্যায় শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেলে শনিবার না হলে রোববার ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা।