সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে মুখোমুখি সিইসি হুদা ও কমিশনার মাহবুব তালুকদার

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.03.02
ঢাকা
সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে মুখোমুখি সিইসি হুদা ও কমিশনার মাহবুব তালুকদার পৌরসভা নির্বাচনে চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি কেন্দ্রে ভোটারদের সারি। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১।
[বেনারনিউজ]

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রশ্নবিদ্ধ বিভিন্ন নির্বাচন প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্যের জের ধরে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে মঙ্গলবার প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে কড়া ভাষায় সমালোচনা করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে. এম. নুরুল হুদা। 

দেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা নজিরবিহীন উল্লেখ করে কেউ কেউ মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে তাঁরা বলেছেন, সিইসি এবং একজন কমিশনারের মধ্যে প্রকাশ্য বিরোধ দেশের গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। 

নির্বাচন কমিশনের ভেতরের এই বিরোধ এমন সময়ে প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে, যখন স্থানীয় বিভিন্ন নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না বলে বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করছে। এমনকি ভোট দেওয়ার প্রতিও মানুষের আগ্রহ বেশ কমেছে।

নির্বাচন কমিশন অডিটোরিয়ামে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত জাতীয় ভোটার দিবসের আলোচনা সভায় নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন “এককেন্দ্রিক স্থানীয় নির্বাচনের তেমন গুরুত্ব নেই। নির্বাচনে মনোনয়ন লাভই এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় নির্বাচনেও হানাহানি, মারামারি, কেন্দ্র দখল, ইভিএম ভাঙচুর ইত্যাদি মিলে এখন অনিয়মের মডেল তৈরি হয়েছে।”

তিনি বলেন, “নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার না হলে এখন যে ধরনের নির্বাচন হচ্ছে তার মান আরও নিম্নগামী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”

মাহবুব তালুকদারের বক্তব্যের পর পরই সিইসি নুরুল হুদা তাঁকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন।

তিনি বলেন, “বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে হেয়, অপদস্থ ও নিচে নামানোর জন্য নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার যা করা দরকার সবই করে চলেছেন। তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থে ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কমিশনকে হেয় করছেন।”

তিনি বলেন, মাহবুব তালুকদার সাহেব অভ্যাসগতভাবে নির্বাচন কমিশনে যোগ দেয়ার পরদিন থেকে যা কিছু ইসির নেগেটিভ দিক, তা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে পাঠ করতেন। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

“দেশের নির্বাচন কমিশনের স্বার্থে তিনি কাজ করেন না; ব্যক্তি স্বার্থে ও একটা উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য এবং কমিশনকে অপদস্থ করার জন্য যতটুকু যা করা দরকার ততটুকু করেছেন উনি,” বলেন সিইসি।

“নির্বাচন কমিশনে যোগ দেওয়ার পর যতগুলো সভা হয়েছে, সব সভায় তিনি এটা করে আসছেন,” মন্তব্য করে নুরুল হুদা বলেন, “ভেবেছিলাম ভোটার দিবস হিসেবে তিনি কিছু বলবেন; কিন্তু তিনি রাজনৈতিক বক্তব্য রাখলেন।”

ভোটার দিবসের অনুষ্ঠানে সিইসি প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন। তিনিই শেষ বক্তা ছিলেন। ফলে সিইসির সমালোচনার জবাবে মাহবুব তালুকদার কোনো বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাননি।

এ প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্বাধীন, কমিশনাররাও স্বাধীন। কিন্তু বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার এই পদের সম্মান রাখতে পারছেন না। যে কথা আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি।”

তিনি বলেন, “প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসাবে উনার কথাবার্তা, আচরণ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, সবকিছুই এই প্রতিষ্ঠানের সাথে মানায় না। মাহবুব তালুকদার একজন স্বাধীনচেতা মানুষ। উনি বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সত্য কথাগুলো বলেছেন।”

মির্জা ফখরুল বলেন, “আমরা যে কথা বলে আসছি কমিশনার মাহবুব তালুকদার সেই কথা বলছেন।” 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান বেনারকে বলেন, “আমি বাংলাদেশের ৫০ বছর রাজনীতিতে নির্বাচন কমিশনারদের মধ্যে প্রকাশ্যে এমন নজিরবিহীন দ্বন্দ্ব দেখিনি। এই ঘটনা প্রতিষ্ঠান হিসাবে নির্বাচন কমিশনকে জনগণের কাছে হেয় করেছে, নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়েছে।” 

তিনি বলেন, “মাহবুব তালুকদার নির্বাচন বিষয়ে বিভিন্ন কথা সব সময়ই বলে আসছেন। এটি নতুন কিছু নয়। কিন্তু সিইসি মাহবুব তালুকদারকে সবার সামনে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন।” 

অধ্যাপক তারেক বলেন, “টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে মাহবুব তালুকদারের ব্যাপারে তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সিইসি নুরুল হুদা। কিন্তু তিনি রাগ, অনুরাগ ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে কিছু করবেন না বলে শপথ নিয়েছেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন।” 

তিনি বলেন, “এভাবে কথা না বলে মাহবুব তালুকদার তাঁর বক্তব্যে যেসব ‘অসত্য কথা’ বলেছেন সেগুলোর জবাব সুন্দর ভাষায় তথ্য উপাত্তসহ তুলে ধরতে পারতেন। অথবা কমিশনের সভায় তিনি বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে সমাধান করতে পারতেন।” 

অধ্যাপক তারেক বলেন, “এইভাবে প্রকাশ্যে দুই কমিশনারের দ্বন্দ্ব প্রমাণ করে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও নির্বাচন কমিশনকে আমরা একটি স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। আরও প্রমাণ হয়েছে যে, সিইসি কমিশনের সঠিক নেতৃত্ব পারেননি।” 

“নির্বাচন কমিশনে যে ঘটনা ঘটে গেলো, তা সত্যিই দুঃখজনক ও হতাশার ব্যাপার,” বলে বেনারকে জানান সাবেক নির্বাচন কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, “নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার এর প্রধান। কমিশনারদের মধ্যে মত পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি আলোচনার জন্য কমিশন রয়েছে। কমিশনের পরিবর্তে প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া পুরো কমিশনের জন্য লজ্জাজনক ঘটনা।”

“এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে না বলে নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা,” বলেন সাখাওয়াত হোসেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।