স্বচ্ছ নির্বাচন প্রসঙ্গে কূটনীতিকদের বক্তব্যে সরকারের মন্ত্রীরা ক্ষুব্ধ
2022.11.16
ঢাকা
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি কূটনীতিকদের একের পর এক বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সরকারের একাধিক মন্ত্রী। এমনকি বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র জাপানের রাষ্ট্রদূতকে মঙ্গলবার তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বুধবার এক ফেসবুক পোস্টে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকিকে তলব করার কথা উল্লেখ করে বলেন, “তাঁকে যা বলার দরকার আমরা বলেছি। সবকিছু সংবাদমাধ্যমকে জানানোর দরকার নেই, তাই এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না।”
১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশনের ৪১ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর ব্যাপারে কূটনীতিকদের সতর্ক করেন তিনি।
গত সোমবার ঢাকায় সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বলেন, জাপান আশা করে বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হবে।
গত নির্বাচন সম্পর্কে জাপানের রাষ্ট্রদূত বলেন, “আমি শুনেছি, আগের রাতে পুলিশ অফিসাররা ব্যালট বাকশো ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে একই ধরনের উদাহরণ শুনিনি। তাই ব্যালট বাকশো ভর্তির পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয়।”
বেনারনিউজ বিষয়টি নিয়ে বুধবার জাপান দূতাবাসের বক্তব্য চেয়ে যোগাযোগ করলেও এখনো জবাব আসেনি। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৯ নভেম্বর জাপান সফর করবেন।
‘রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য বিস্ময়কর’
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বুধবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে জাপানি রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য বিস্ময়কর। কারণ প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের আগে তিনি এমন একটি বিতর্কিত ইস্যুতে মন্তব্য করেছেন।”
“এই মন্তব্য এবং তার প্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তলব করার ঘটনা বাংলাদেশ-জাপান সহযোগিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে," মনে করেন তিনি।
শমসের মবিন বলেন, “জাপানি রাষ্ট্রদূতকে তাঁর মন্তব্যের জন্য তলব করে সরকার অন্য রাষ্ট্রদূতদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে কথা না বলার বার্তা দিয়েছে।”
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের নির্বাচনে স্বচ্ছতার বিষয়ে কথা বলেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী এবং সরকারি দলের নেতারা এসব বিষয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বক্তব্য দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক কূটনীতিকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে তাঁদের সতর্ক হওয়া উচিত। কারণ এটি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমরা কখনই কারো কাছে মাথা নত করব না।”
বুধবার মেহেরপুরে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বললে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এর আগে ৮ নভেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছিলেন, “নির্বাচনে কে জিতবে যুক্তরাষ্ট্র সেটাকে গুরুত্ব দেয় না, বরং সেখানে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে চিন্তা করে।”
ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন ১৭ অক্টোবর সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ফারুক খান বুধবার বেনারকে বলেন, “আমরা প্রায়ই কূটনীতিকদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে মন্তব্য করতে দেখি, যা ভিয়েনা কনভেনশনের বিরোধী। তাঁরা দুটি কারণে কথা বলেন। প্রথমত, অনেক কূটনীতিক তাঁদের দায়িত্বের পরিধি সম্পর্কে অবগত নন। দ্বিতীয়ত: কিছু রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়া তাঁদের রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলতে উস্কানি দেয়।”
তিনি বলেন, “বিরোধী দলগুলোর বোঝা উচিত যে কূটনীতিকরা তাদের ক্ষমতায় বসাবে না। তাদের ক্ষমতায় আসার জন্য জনগণের ম্যান্ডেট পেতে হবে।”
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে কূটনীতিকদের মন্তব্যের সংবাদ পরিবেশন না করার জন্য তিনি সংবাদ মাধ্যমকে অনুরোধ জানান।
উল্লেখ্য, আগামী বছরের ডিসেম্বর অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন হওয়ার কথা।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কূটনীতিকদের বক্তব্য সব সময় সরকার অপছন্দ করে এবং বিরোধীরা স্বাগত জানায়। মূলত ১৯৯৫ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর রাজনীতিতে কূটনীতিকদের অংশগ্রহণ শুরু হয়।