বাংলাদেশ ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হবে বলে একজন নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য ঘিরে বিস্ময়
2024.01.02
ঢাকা
জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে করতে না পারলে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়ে যাবে বলে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের মন্তব্য ঘিরে নানা সমালোচনা-পর্যালোচনা হলেও তাঁর এমন বক্তব্য দেয়ার কারণ স্পষ্ট নয়। মঙ্গলবার তিনি এই বক্তব্য দেওয়ার পর অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাংবিধানিক পদে থেকে তিনি এমন মন্তব্য করতে পারেন না।
মঙ্গলবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে আনিছুর রহমান বলেন, “যদি কোনো কারণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না করতে পারি, যদি কোনো কারণে ব্যর্থ হই, তাহলে আমাদের রাষ্ট্র নিজেই ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যাবে।”
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ওপর আন্তর্জাতিক নজর রয়েছে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কোনোভাবেই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা-২ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী এবং দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, একজন নির্বাচন কমিশনারের এ ধরনের শব্দ ব্যবহার ঠিক হয়নি। এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি তিনি।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমানের বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে মঙ্গলবার তাঁর সাথে বেনারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
জনমনে ‘বিভ্রান্তি’ ও ‘ভীতির’ সঞ্চার করবে
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমার মতে, নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি ‘রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে অথবা ব্যর্থ রাষ্ট্র’-এমন শব্দগুলো ব্যবহার করা উচিত হয়নি। কারণ এগুলো মারাত্মক শব্দ।”
তিনি বলেন, “গত নভেম্বরে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বলেছিলেন যে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ওপর বিদেশীরা থাবা বিস্তার করেছে। এই ধরনের কথা জনমনে বিভ্রান্তি এবং ভীতির সঞ্চার করবে।”
আনিছুর রহমানের কথার “বিভিন্ন অর্থ দাঁড়াতে পারে,” জানিয়ে তিনি বলেন “কেউ কেউ এমন কথাও বলতে পারেন যে, তাঁর কাছে তথ্য রয়েছে যে বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে। সেকারণেই তিনি এই কথা বলেছেন। আর যদি তেমন কোনো তথ্য থাকে তাহলে তাঁরা নির্বাচন বন্ধ করছেন না কেন? সেই প্রশ্ন আসবে।”
“উনি যে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন সেটি কি হচ্ছে? এটি কি কোনো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হচ্ছে? এটি তো একতরফা নির্বাচন,” বলেন ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত।
“একই দল ও জোট নিজেদের মধ্যে প্রার্থী ভাগাভাগি করে নির্বাচন করছে। এটি তো প্রকৃত নির্বাচন নয়। স্থানীয় পর্যায়ে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে কি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব?,” যোগ করেন তিনি।
তাঁর মতে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনাররা “তাঁদের বক্তব্যের মাধ্যমে তাঁরা যে আগামী নির্বাচনের দায়দায়িত্ব নিতে চান না সে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। এর মূল কারণ হলো, বিদেশিদের কাছে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার রাখা।”
“তাঁরা বলতে পারবেন, প্রশাসনিকভাবে সব চেষ্টা করলেও রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে আসেনি। বিদেশিদের কাছে পরিষ্কার থাকার চেষ্টা করার কারণ হলো তাঁদের অনেকের পরিবারের সদস্যরা বিদেশে থাকেন। তাঁদের জন্য ভিসা নীতি কার্যকর হলে সমস্যা হতে পারে,” যোগ করেন তিনি।
গত বছর ২৭ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, “তারা (বিদেশিরা) থাবা বিস্তার করে রেখেছে। সেই থাবা থেকে দেশের অর্থনীতি, ভবিষ্যৎ, গার্মেন্টস ও গণতন্ত্র বাঁচাতে হলে আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে।”
গত ৩১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, “আমরা যদি আমাদের এই নির্বাচন সুষ্ঠু, সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য করতে না পারি; তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বাংলাদেশের সকল বিষয়; বিশেষ করে আর্থিক, সামাজিক, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবকিছু থমকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, বাংলাদেশ হয়তোবা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকবে।”
নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হলে সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে নানা মন্তব্য করা হচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমানের বাংলাদেশের ব্যর্থ রাষ্ট্র হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে দেয়া বক্তব্য ঘিরে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে না পারলে বাংলাদেশ ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ হয়ে যাবে বলে আনিছুর রহমানের বক্তব্য “একটি বিরাট স্টেটমেন্ট,” উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের প্রধান (জানিপপ) নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “বিষয়টি হালকাভাবে নেওয়ার কিছু নেই।”
তিনি বলেন, এর আগের নুরুল হুদা কমিশন, এবং কাজী রকিব কমিশনের কোনো কমিশনার এমন কথা বলেননি জানিয়ে তিনি বলেন, আনিছুর রহমান “হয়তো বুঝতে পারছেন যে ভোটারবিহীন একটি নির্বাচন হলে দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কতটা ক্ষতি হতে পারে।”
উল্লেখ্য, প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর বয়কটের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। নির্বাচন ঘিরে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে নানা সমালোচনা রয়েছে।
কমিশনের হিসাবে, নিবন্ধিত মোট ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৯টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ঘিরে প্রশ্ন রয়েছে। এর পাশাপাশি সরকারি দল আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে গেছে।