পঞ্চম ধাপের ইউপি নির্বাচনে প্রাণ গেল ১০ জনের
2022.01.05
ঢাকা
পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ভোট চলাকালে ও ভোটের পর নির্বাচনী সহিংসতায় বুধবার রাত পর্যন্ত পাঁচ জেলায় দুই নারীসহ কমপক্ষে ১০ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ভোট চলাকালে পৃথক সংঘর্ষে চাঁদপুরে দুইজন এবং মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা, চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় একজন করে নিহত হয়েছেন বলে বিকেলে ঢাকায় সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মুখপাত্র ও সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার।
পরে সন্ধ্যায় ভোটগণনার সময় উত্তেজিত আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা প্রতিহতকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বগুড়ায় আরো চারজনের মৃত্যুর খবর বেনারকে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় গাবতলী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়া লতিফুল ইসলাম।
“পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেখানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা গুলি ছোড়ে,” উল্লেখ করে তিনি জানান, নিহত চারজনই গাবতলী উপজেলার বালিয়াদীঘি ইউনিয়নের কালাইহাটা গ্রামের বাসিন্দা। যার মধ্যে একজন নারীও রয়েছেন।
সেখানকার আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী ইউনুছ আলী ফকির স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচন কর্মকর্তারা ভোট গণনা নিয়ে টালবাহানা করার কারণে ভোটাররা কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নেন। তাঁদের হটিয়ে দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে।
এতে ঘটনাস্থলেই তিনজন এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরো একজন মারা গেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান মতে, পঞ্চম ধাপের সহিংসতায় দশজনসহ গত জুনে ইউপি নির্বাচন শুরু হবার পর থেকে নির্বাচনী সহিংসতায় কমপক্ষে ১১০জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
এদিকে, ঢাকার সাভারের আশুলিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ ও আশুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন শেষে এক লিখিত প্রতিক্রিয়ায় দেশজুড়ে সংঘাতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।
“সন্ত্রাস ও সংঘর্ষ যেন ইউপি নির্বাচনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এখন ভোটযুদ্ধে যুদ্ধ আছে, ভোট নেই,” বলেন তিনি।
এর আগে সাভারের সাংবাদিকদেরও তিনি ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম দেখতে পাওয়া কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “নির্বাচনের মৌলিক শর্ত ভোটের আগে ও পরে ব্যালট পেপারের নিরাপত্তা বিধান। আমরা যথাযথভাবে তা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এর দায় এড়াতে পারবে বলে মনে হয় না।”
ভোটগ্রহণ চলাকালে নিহত ছয়
পঞ্চম দফায় ভোটগ্রহণ চলাকালে নির্বাচনী সহিংসতায় ছয়টি মৃত্যুর ঘটনাকে ‘দুঃখজনক’ ও ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ উল্লেখ করে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মুখপাত্র ও সচিব হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সাংবাদিকদের বলেন, “তাঁরা সবাই ভোট কেন্দ্রের বাইরে দুই প্রার্থীর সংঘর্ষে মারা গেছেন। প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা এর দায় নেবেন।”
এ দফায় দেশের ৭০৮টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোটগ্রহণ শেষে ঢাকায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন ইসি সচিব। ইসি সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বলেও দাবি করেন এই কর্মকর্তা।
তাঁর দেওয়া তথ্যানুযায়ী, মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার বাচামারা ইউনিয়নে ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় দুই প্রার্থীর ধাওয়াপাল্টা-ধাওয়ার মধ্যে পড়ে আমেনা খাতুন (৫০) নামে এক নারী নিহত হন।
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে অংকুর দাস (৩৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন।
এছাড়া গাইবান্ধার সাঘাটায় জুমারবাড়ী ইউনিয়নে আবু তাহের (৪০), বগুড়ার গাবতলীর রামেশ্বরপুরে জাকির হোসেন (৩৫) এবং চাঁদপুরের কচুয়ায় শরীফ হোসেন (১৮) ও হাইমচরে এক অজ্ঞাত যুবক (২৮) মারা গেছেন।
ওই কয়টি জায়গা ছাড়া পুরো দেশে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হয়েছে বলেও দাবি করেন সচিব। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের তিনি আরো বলেন, “এখন পর্যন্ত যা হয়েছে তাতে বলব, ভালো নির্বাচন হয়েছে। সামনে যে নির্বাচন হবে সেটি আরও ভালো হবে।”
যা বলছে বিএনপি-আওয়ামী লীগ
“ইউপি নির্বাচনের এমন সহিংসতায় এটাই প্রমাণিত হলো যে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এতে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল,” বেনারকে বলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
“আওয়ামী লীগ এখন নিজেরা নিজেরা নির্বাচন করার পরেও যেভাবে এত মানুষ মারা যাচ্ছে, তাতে এটা সহজেই বোধগম্য যে এই ভোটে বিএনপি ও অন্যান্য দল অংশ নিলে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে রাখার জন্য ক্ষমতাসীনরা আরো ভয়ংকর ও সহিংস হয়ে উঠত,” যোগ করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, “মানুষের কাছে আওয়ামী লীগের চরিত্র ইতিমধ্যে উন্মোচিত হয়েছে। তারা কতটা ভয়ংকর হতে পারে তা এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আরো স্পষ্ট হলো। ফলে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট হলে যে কোনো নির্বাচনেই আওয়ামী লীগকে মানুষ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করবে।”
তবে “বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সবসময়ই কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটে,” দাবি করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম বাহাউদ্দীন নাসিম বেনারকে বলেন, “বিপুল সংখ্যক ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হচ্ছে, সেই তুলনায় যে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে তা খুব বেশি নয়। তবে কোনো প্রকার নির্বাচনী সহিংসতা বা কারো মৃত্যুই আমাদের কাম্য নয়।”
“আমরা আশা করব নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এ ব্যাপারে আরো তৎপরতা দেখাবেন,” বলেন তিনি।
তাঁর মতে, “বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনের প্রেক্ষাপট পুরোপুরি ভিন্ন। তাই জাতীয় নির্বাচনে এই নির্বাচনের প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই।”
নির্বাচনী ব্যবস্থা বলতে কিছুই নেই
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “নির্বাচনী ব্যবস্থা বলতে দেশে আর কিছুই নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচনটাও শেষ হয়ে গেলো। ভবিষ্যতে যে কোনো নির্বাচনেই এই সহিংসতা প্রভাব থাকবে এবং এটি হবে দীর্ঘমেয়াদী।
“নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে সব রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই,” বলেন তিনি।
সুজনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, দেশে এর আগে নয়বার ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩ ও ১৯৯২ সালের নির্বাচনে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। তবে ১৯৮৮ সালে ৮০, ১৯৯৭ সালে ৩১, ২০০৩ সালে ২৩, ২০১১ সালে ১০ জন নিহত হন।
২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে সহিংসতায় মারা যান ১৪৩ জন।
এবারের নির্বাচনে সহিংসতা গতবারের চেয়ে বাড়তে পারে এমন শঙ্কা প্রকাশ করে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার জানান, সহিংসতাগুলোর অধিকাংশই ঘটছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও এর বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে, যাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় সরকার নির্বাচন আর বাংলাদেশের নির্বাচন ছাড়া এমন সংঘাত ও সহিংসতার খবর আর কোনো দেশের নির্বাচনে পাওয়া যায় না বলেও মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালে ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় ৬৭২টি সহিংসতার ১১৩ জন নিহত হয়েছেন বলে গত ৩১ ডিসেম্বর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল মানবাধিকার সংগঠন আসক।