তিন ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় মৃত্যু ৮০, বাকি আরও দুই ধাপ

আহম্মদ ফয়েজ
2021.11.29
ঢাকা
তিন ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় মৃত্যু ৮০, বাকি আরও দুই ধাপ টাঙ্গাইল কালিহাতি উপজেলার একটি কেন্দ্রে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ভোট দেবার জন্য এক প্রবীণ নারীকে কোলে করে নিয়ে আসছেন এক তরুণ। ২৮ নভেম্বর ২০২১।
[ফোকাস বাংলা]

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে সহিংসতার ঘটনা। গত এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ গেছে কমপক্ষে ৮০ জনের। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবের সঙ্গে নভেম্বর অনুষ্ঠিত দুটি ইউপি নির্বাচনে মৃত্যুর তথ্য যুক্ত করে এই সংখ্যা পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ রোববার তৃতীয় ধাপে ৯৮৬টি ইউপিতে নির্বাচন চলাকালে এবং এর পরবর্তীতে সংঘাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মারা গেছেন কমপক্ষে ১০জন, আহত হয়েছেন শতাধিক। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

পুলিশের তথ্য অনুযায়ী এর আগে গত ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে ভোটের দিন প্রাণ হারান সাত জন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সহিংসতার এই ধারা অব্যাহত থাকলে নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়াবে। তিন ধাপের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আরও অন্তত দুটি ধাপ বাকি আছে, যা ডিসেম্বরে হওয়ার কথা।

নেপথ্যে ‘ক্ষমতার লড়াই

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) তথ্যমতে, দেশে এর আগে নয়বার ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩ ও ১৯৯২ সালের নির্বাচনে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।

তবে ১৯৮৮ সালে ৮০, ১৯৯৭ সালে ৩১, ২০০৩ সালে ২৩, ২০১১ সালে ১০ জন নিহত হন।

২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে সহিংসতায় মারা যান ১৪৩ জন।

“আমাদের আশঙ্কা যে, সর্বশেষ দুই দফার নির্বাচনে যে হারে সহিংসতা হয়েছে তা অব্যাহত থাকলে এবারের নির্বাচনে সহিংসতা গতবারের চেয়ে বাড়তে পারে,” বেনারকে বলেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।

চলতি ইউপি নির্বাচন প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ প্রায় বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই বয়কট করেছে, তবুও কেন এই সহিংসতা? এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞ বদিউল আলম বলেন, “এই সহিংসতার নেপথ্য কারণ মূলত ক্ষমতার লড়াই ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন। ক্ষমতাসীনদের দলীয় প্রতীক পাওয়া মানেই জিতে যাওয়ার বিষয়টি মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ায় মূলত ক্ষমতাসীনদের মধ্যেই এই সংঘাতগুলো হচ্ছে।”

তাঁর মতে, “যেহেতু নির্বাচিত হলে অর্থবিত্ত তৈরি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যাবে, তাই তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বেশিরভাগ এলাকায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কথা শুনতে চাইছে না।”

“সহিংসতার ঘটনাগুলোর অধিকাংশই ঘটছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও এর বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে, যাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী,” বলেন বদিউল আলম মজুমদার।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় সরকার নির্বাচন আর বাংলাদেশের নির্বাচন ছাড়া এমন সংঘাত ও সহিংসতার খবর আর কোনো দেশের নির্বাচনে পাওয়া যায় না বলেও মন্তব্য করেন বদিউল আলম।

তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ.ফ.ম বাহাউদ্দীন নাসিমের মতে, “সহিংসতার ঘটনাগুলোর সবই যে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হচ্ছে তা ঠিক নয়।”

তাঁর মতে, “পুরনো জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধেও অনেকে হতাহত হচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচন চলতে থাকায় এসব এখন নির্বাচনী সহিংসতা হিসেবে মূল্যায়িত হচ্ছে।”

দলের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে আওয়ামী লীগ কঠোর ভূমিকা রাখছে দাবি করে নাসিম বেনারকে বলেন, “দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে যারা নির্বাচনে বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে দলীয় হাইকমান্ড তাদের বিষয়ে কঠোর। ইতোমধ্যে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বহিষ্কার করা হয়েছে।”

নির্বাচনে অংশ না নেয়া এবং চলমান সহিংসতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বেনারকে বলেন, “বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশন পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাকে তামাশায় পরিণত করেছে। এখন নির্বাচনের নামে চলছে ক্ষমতা দখলের মহড়া। এমন বাস্তবতায় এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়াকে যৌক্তিক মনে করেনি বিএনপি।”

“এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের লোকেরা প্রমাণ করছে, তারা আসলে কতটা সহিংস। এমন সহিংসতা এ দেশের মানুষ পছন্দ করে না,” যোগ করেন এই সিনিয়র বিএনপি নেতা।

এদিকে “নির্বাচন কমিশন সহিংসতা ঠেকাতে বারবার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাঠ পর্যায়ের নির্বাচন কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দিয়ে আসছে,” জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “কিন্তু হঠাৎ করে সহিংসতার ঘটনা ঘটে গেলে কিছু করার থাকে না।”

নির্বাচনী প্রচারণায় তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী নজরুল ইসলাম ঋতু। [বেনারনিউজ]
নির্বাচনী প্রচারণায় তৃতীয় লিঙ্গের প্রার্থী নজরুল ইসলাম ঋতু। [বেনারনিউজ]

দেশে তৃতীয় লিঙ্গের প্রথম চেয়ারম্যান

রোববার ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের ত্রিলোচনপুর ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী বর্তমান চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামকে হারিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন নজরুল ইসলাম ওরফে ঋতু হিজড়া। ঋতুই বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বলে নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি।

নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন ঋতু।

“আমি যেন কারো থেকে আলাদা না হই। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে চাই। আমি আলাদাভাবে নয় সবার মতো থাকতে চাই। আমার ইউনিয়নের উন্নয়নের উন্নয়নে সবার সহযোগিতা চাই,” নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে জানান ঋতু। 

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ২৫২ চেয়ারম্যান

চলমান ইউপি নির্বাচনের প্রথম তিন ধাপে ২৫২ জন চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ভোটারদের রায় ছাড়াই নির্বাচিত হওয়া এই জনপ্রতিনিধিদের প্রায় সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) তথ্যমতে, সর্বশেষ ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ২১২ জন চেয়ারম্যান পদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর আগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবার কোন রেকর্ড ইসিতে পাওয়া যায়নি।

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবার এই প্রবণতাকে “নির্বাচনী সংস্কৃতির জন্য খুব খারাপ,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ।

তাঁর মতে, “যারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছে, তারা প্রবল ক্ষমতাবান বলেই অন্যদের প্রার্থী হতে দিচ্ছেন না। এই বিষয়গুলো নির্বাচন কমিশনের দেখা উচিত।”

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “কোনো প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলে আইনগতভাবে এটা কোনো সমস্যা না। কিন্তু কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে কেউ যদি কোনো অভিযোগ দায়ের করে তাহলে ইসি সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়।”

প্রথম ধাপে ২১ জুন ২০৪ ইউপি ও ২০ সেপ্টেম্বর ১৬০ ইউপির ভোট হয়। দ্বিতীয় ধাপে ৮৩৫ ইউপির ভোট হয়েছে ১১ নভেম্বর। চতুর্থ ধাপের ভোট হবে ৮৪০ ইউপিতে ২৬ ডিসেম্বর এবং পঞ্চম ধাপে ৭০৭টি ইউপিতে ভোট হবার কথা আগামী ৫ জানুয়ারি ২০২২।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।