খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুষ্ঠু নির্বাচনে পদক্ষেপ নিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ৬ সদস্যের আহ্বান
2023.06.13
ঢাকা

বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠান ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য পদক্ষেপ নিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রধান ও ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেপ বোরেলকে চিঠি পাঠিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য।
সোমবার ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ছয়টি দেশের ছয় সাংসদ এই যৌথ চিঠিটি পাঠিয়েছেন বলে বেনারকে নিশ্চিত করেছেন স্লোভাকিয়ার সংসদ সদস্য ইভান স্টেফানেকের সংসদীয় সহকারী ভেরোনিকা প্রাইসেলোভা। বেনারের পক্ষ থেকে পাঠানো এক ই-মেইল বার্তার উত্তরে স্টেফানেকের পক্ষ থেকে তিনি চিঠিটির সত্যতা নিশ্চিত করেন।
এদিকে এই চিঠি পাঠানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনবারের বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী কারাবন্দি খালেদা জিয়া আবারো হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সোমবার দিবাগত রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় বলে গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
ইইউকে ‘বাস্তব ফলাফল’ আনার আহ্বান
চলতি বছরের ডিসেম্বর বা আগামী বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এবং অবনমিত মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ভূমিকা রাখতে বোরেলকে চিঠি পাঠান ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারী ছয় সদস্য হলেন— ইভান স্টিফেনেক (স্লোভাকিয়া), মিকেইলা সিজদ্রোভা (চেক প্রজাতন্ত্র), অ্যান্দ্রে কোভাচভ (বুলগেরিয়া), কারেন মেলচিয়র (ডেনমার্ক), হ্যাভিয়ের নারত (স্পেন) ও হেইডিহাউতালা (ফিনল্যান্ড)।
“বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে,” প্রচেষ্টার আহবান জানিয়েছেন এই ছয় সংসদ সদস্য।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাঁরা ‘আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুনরুদ্ধারের’ পদক্ষেপ নিতে ইইউ নেতৃত্বের প্রতি আহবান জানান।
বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন, মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং চলমান সংকটের টেকসই ও গণতান্ত্রিক সমাধানে বিএনপি ও অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে অবদান রাখার জন্য বোরেলকে অনুরোধ করেন।
“সুতরাং, ইইউকে কেবল মানবাধিকার এজেন্ডায় বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের সাথে নিরবচ্ছিন্ন সংলাপে থাকলেই চলবে না, বরং বাস্তব ফলাফলও আনতে হবে,” বলা হয় চিঠিতে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী এবং জড়িত ব্যক্তিদের ইউরোপিয়ান ইকোনমিক জোনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা বা জিএসপি প্লাস প্রণোদনার শর্তগুলো নিয়মিত স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরামর্শ এই ইইউ আইন প্রণেতাদের।
এই সদস্যরা বলেন, “এই চিঠির মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছি এবং আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানাচ্ছি।”
চিঠিতে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করেছে এবং সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে ব্যর্থ হয়েছে।
চিঠিতে এমপিরা অভিযোগ করেন, ক্ষমতা সুসংহত করতে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা দিয়ে যাচ্ছে।
তাঁদের আরও অভিযোগ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ মত প্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস পেয়েছে, বিশেষত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রণয়নের পর থেকে।
“হেফাজতে নির্যাতন এবং অন্যান্য দুর্ব্যবহারের অভিযোগ প্রায়শই বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সাথে সম্পর্কিত ছিল। এই নিপীড়ন শুধু সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীসহ জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্যও সমানভাবে প্রযোজ্য,” বলা হয় চিঠিতে।
এতে বলা হয়, গত এক দশকে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং জোরপূর্বক গুমের উচ্চ হার জাতিসংঘের মানবাধিকার, নির্যাতন বিরোধী জাতিসংঘ কমিটির মতো ব্যবস্থাসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, “আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, দেশটিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকায় জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার এখনো নির্ধারিত হয়নি। দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কারচুপি, জালিয়াতি ও ভোটার উপস্থিতি না থাকায় এগুলো ছিল ত্রুটিপূর্ণ।”
দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেটি আগের রাতেই ভোট শেষ হওয়ায় মিডনাইট ইলেকশন নামে পরিচিতি পেয়েছে, বলা হয় চিঠিতে।
চিঠিতে বলা হয়, এই দুটি নির্বাচন এমন হওয়ায় এসব নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারগুলি বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে ম্যান্ডেট পায়নি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
তথ্যমন্ত্রীর মতে চিঠিটি ‘গুরুত্বহীন’
এদিকে ছয় ইউরোপীয় সাংসদের চিঠি “কোনো গুরুত্ব নেই” বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “সাত শতাধিক এমপির মধ্যে ছয়জন একটি চিঠি দিয়েছে, এটার কোনো গুরুত্ব নেই। এই চিঠি আমার কাছে গুরুত্বহীন।”
“এটা ওই পার্লামেন্টের কোনো রেজুলেশন নয়, সুতরাং এটা গুরুত্বহীন। এই এমপিদের উচিত ইইউভুক্ত দেশগুলোতে যে সমস্ত ঘটনা ঘটছে সেগুলোর দিকে নজর দেওয়া,” বলেন মন্ত্রী।
তবে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্যের এই চিঠি ‘গুরুত্বহীন নয়’ বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বেনারকে বলেন, এই চিঠি এবং কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ ইস্যুতে ছয়জন মার্কিন কংগ্রেসম্যানের চিঠিকে দেখতে হবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত বাংলাদেশের ভিসা নীতির ফলোআপ হিসেবে।
“পশ্চিমারা বাংলাদেশে নানা কারণেই একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়। সেটির জন্য শুধু ভিসা নিষেধাজ্ঞাই যথেষ্ট নয়, এটা তারা জানে। তাই এসব চিঠি, যার ফলশ্রুতিতে ভবিষ্যতে আরো উদ্যোগ হয়তো দেখা যাবে,” বলেন এই সাবেক কূটনৈতিক।
তৌহিদ হোসেন বলেন, সরকার হয়তো বিষয়টিকে হালকাভাবে নিয়েছে এমন একটি অবস্থান দেখানোর চেষ্টা করবে, তবে আসলে এটা হালকাভাবে নেওয়ার মতো বিষয় নয়।