হাতি সংরক্ষণে বন বিভাগের প্রকল্প নাকচ করেছে সরকার

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.05.10
ঢাকা
হাতি সংরক্ষণে বন বিভাগের প্রকল্প নাকচ করেছে সরকার কক্সবাজারে টেকনাফের একটি রোহিঙ্গা শিবির এলাকায় বন্য হাতির ব্যাপারে মাইকিং করে সতর্ক করছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। ৭ নভেম্বর ২০২১।
[আব্দুর রহমান/বেনারনিউজ]

দেশের বিভিন্নস্থানে মানুষ-হাতি সংঘাত বন্ধ করতে বন বিভাগ প্রস্তাবিত ‘হাতি সংরক্ষণ’ প্রকল্প বাতিল করেছে সরকারের পরিকল্পনা কমিশন, যার সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিতব্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (জুলাই ২০২৩-জুন ২০২৪) অন্তর্ভুক্ত প্রকল্পের তালিকা থেকে হাতি সংরক্ষণ প্রকল্পটি বাদ দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে কমিশনের সংশ্লিষ্ট শাখা।

প্রকল্পটির খরচ ধরা হয়েছিল প্রায় ৫০ কোটি টাকা। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উত্থাপন করা হয় না। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একনেক সভায় পাশ না হলে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় না।

পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট শাখার যুগ্মসচিব মোহাম্মদ মফিজুর রহমান বেনারকে বলেন, “আমরা বন বিভাগ থেকে হাতি সংরক্ষণ প্রকল্পটি পেয়েছি এবং প্রকল্পটি বাদ দেয়া হয়েছে। এটি পাশের জন্য একনেকে উপস্থাপন করা হবে না।”

পরিকল্পনা কমিশন বিষয়টি বন বিভাগকে জানিয়ে দিয়েছে বলে জানান মফিজুর রহমান।

প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আমরা জানি না কেন প্রকল্পটি পাশ করা হচ্ছে না। হয়তো পরে জানতে পারব।”

তবে প্রকল্পটি পাশ হলে হাতি সংরক্ষণ কাজ আরও গতিশীল হতো এবং মানুষ-হাতি সংঘাত কমানো যেত।

পরিকল্পনা কমিশন কর্মকর্তারা বলেন, গত বছর আর্থিক কৃচ্ছ্রসাধন করতে অগ্রাধিকার প্রকল্পের একটি তালিকা প্রণয়ন করেছে সরকার। সেই অগ্রাধিকার তালিকাতেও হাতি সংরক্ষণ প্রকল্প রাখা হয়নি।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) বাংলাদেশ শাখার সাবেক প্রধান ও সাবেক প্রধান বন সংরক্ষক ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, প্রতিবছরই দেখা যাচ্ছে মানুষ-হাতি সংঘাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক মানুষ এবং হাতি প্রাণ হারাচ্ছে।

তিনি বলেন, “২০১৬ সালে আমাদের দেশে হাতির সংখ্যা ছিল ২৬৮টি। এর মধ্যে গত ছয় বছরে কমপক্ষে ৫০টি হাতি প্রাণ হারিয়েছে। হাতির প্রজননও খুব দীর্ঘ। এভাবে হাতি মারা যেতে থাকলে বাংলাদেশে হাতি থাকবে না। হাতি পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য খুব দরকারি।”

ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ বলেন, “হাতি সংরক্ষণ প্রকল্পটি অনুমোদিত হওয়া উচিত ছিল। প্রকল্পটি বাদ দেয়া হয়েছে মানে হাতি সংরক্ষণ আমাদের অগ্রাধিকার নয়। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। তাই জীব বৈচিত্র্য রক্ষায় হাতি সংরক্ষণ জরুরি।”

হাতির আক্রমণে তিন সপ্তাহে চার মৃত্যু

প্রতি বছর বিশেষ করে ধান কাটার মৌসুমে হাতি-মানুষ সংঘাতে অনেক মানুষ এবং হাতি প্রাণ হারায়।

সর্বশেষ ৭ মে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের কুমারির চাককাটা এলাকায় বন্য হাতির আক্রমণে আকতার হোসেন (৩৮) নামক এক ব্যক্তি প্রাণ হারান।

গ্রামবাসীরা জানান, পাকা ধান কেটে ঘরের উঠানে রেখেছিলেন আকতার। রা‌ত আড়াইটার দিকে সেই ধান খেতে উঠানে হাজির হয় বন‌্য হাতির দল। হাতিকে তাড়াতে ঘর থেকে লাইট নিয়ে বের হওয়ার পরই হাতির দল তাঁকে আক্রমণ করে। ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।

বন্য হাতির আক্রমণে গত পহেলা মে শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার হাতিবর টিলাপাড়া এলাকায় কৃষক আব্দুল হামিদ প্রাণ হারান।

১৪ এপ্রিল বন্য হাতির হাত থেকে পাকা ধান রক্ষা করতে খেত পাহার দেয়ার সময় শ্রীবরদী এলাকার জুলগাঁও এলাকায় আব্দুল করিম এবং ২৬ এপ্রিল একই জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার পূর্বসমশ্চুড়া গ্রামের বিজয় নামে এক কৃষক প্রাণ হারান।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে এশিয়ান এলিফ্যান্ট নামক হাতি দেখা যায়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব নেচারের লাল তালিকা অনুযায়ী, এই প্রজাতির হাতি হুমকির মুখে।

সংস্থাটির সর্বশেষ ২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২৬৮টি হাতি রয়েছে।

বন বিভাগের হিসাবে হাতি-মানুষ সংঘর্ষ এবং বিদ্যুতায়িত হয়ে ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০টি হাতি প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে ২০২১ সালে ৩৪টি হাতি প্রাণ হারিয়েছে।

বাংলাদেশে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও শেরপুর জেলার ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় হাতির বিচরণ দেখা যায়। কৃষকদের ধান পাকলে পাহাড় থেকে দলে দলে হাতি এসে সেগুলো খেয়ে ফেলে।

ফসল ঠেকাতে গ্রামবাসী মশাল, লাঠি, সড়কি নিয়ে, বিভিন্ন শব্দ করে, কখনও পটকা ফুটিয়ে হাতিকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। গ্রামবাসীর আক্রমণেও হাতি মারা যায়। দলের কোনো হাতি প্রাণ হারালে আক্রমণকারীকে চিনে রাখে তারা। পরে প্রতিশোধ নিতে আক্রমণ করে হাতির দল।

এছাড়াও, হাতিকে ফসল খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে বেআইনিভাবে উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করে গ্রামবাসী। ফসল থেতে এসে বিদ্যুতায়িত হয়ে হাতি মারা যায়।

সমস্যা মানুষের সৃষ্টি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশে বন সংরক্ষণে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান আরণ্যক ফাউন্ডেশনের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বুধবার বেনারকে বলেন, হাতি অত্যন্ত বিচক্ষণ, প্রখর স্মৃতিশক্তিধর এবং একইসাথে হিংস্র ও প্রতিশোধপরায়ণ প্রাণী। তাদের বিরক্ত না করলে এরা হিংস্র হয় না। এরা দলবদ্ধভাবে চলাচল করে। হাতির দল যে পথ দিয়ে যায়, আবার সেই পথ দিয়েই ফিরে আসে। এগুলোকে সাধারণভাবে হাতির করিডোর বলা হয়।

বাংলাদেশে মোট ১২টি হাতির করিডোর রয়েছে।

ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “মানুষের অভিযোগ, হাতি লোকালয়ে নেমে আসে। আসলে কথাটা সঠিক নয়। মানুষ হাতির বিচরণস্থল দখল করে অবকাঠামো নির্মাণ করেছে, চাষাবাদ শুরু করেছে, গাছ কেটে তার খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। এমনকি তার চলাচলের করিডোরটি পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে।”

তিনি বলেন, “হাতি এমন একটি প্রাণী যে, তার চলাচলের পথে বাধা আসলে সেটিকে সরাতে চেষ্টা করবেই। যদি সরাতে না পারে তাহলে কমপক্ষে লাথি দেবে, ধাক্কা দেবে।”

ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “সেকারণে প্রতিনিয়তই আমরা দেখছি, মানুষের সাথে হাতির সংঘাত হচ্ছে। মানুষ মারা যাচ্ছে, হাতি মারা যাচ্ছে। এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। এজন্য বনবিভাগের নেতৃত্বে বিভিন্ন স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় মানুষদের মাধ্যমে এমন একটি ব্যবস্থা করতে হবে যাতে হাতি মানুষের কাছে না আসে।”

যা বলা হয়েছিল প্রকল্প প্রস্তাবনায়

হাতি সংরক্ষণ প্রকল্পের একটি কপি বেনারের কাছে এসেছে।

এই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন বনাঞ্চলে হাতির আবাসস্থল উন্নয়নের মাধ্যমে এর নিরাপদ প্রজনন ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হাতির উপযোগী গাছের বাগান এবং বাঁশ বাগান সৃষ্টি করার প্রস্তাব করা হয়।

হাতির পানির চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন স্থানে ছোটবড়ো জলাধার সৃষ্টিসহ লবণ মিশ্রিত মাটির ঢিবি তৈরি করা যেখান থেকে হাতি তার পানি ও লবণের চাহিদা মেটাবে।

কৃষকদের ফসল খাওয়া থেকে হাতিদের নিবৃত্ত করতে চাষাবাদের জমির চারপাশে বেত, লেবু, মাল্টা ও অন্যান্য কাঁটাযুক্ত গাছ লাগানোর প্রস্তাব করা হয়। হাতি কাঁটাযুক্ত গাছের কাছে যায় না।

একইসাথে ধান, গমের পরিবর্তে হাতির অপছন্দের বিভিন্ন ফসল কাঁচামরিচ, আদা, হলুদ প্রভৃতি চাষ করলে হাতির সাথে মানুষের দ্বন্দ্ব কমে আসবে।

এ প্রসঙ্গে ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বনের যে এলাকায় হাতি বসবাস করে সেখানে হাতির পছন্দের খাবার কলাগাছ, বাঁশ পর্যাপ্ত পরিমাণে লাগাতে হবে যাতে তারা সেখানে খাদ্য পায়। একই সাথে হাতির অপছন্দের ফসল চাষ করতে হবে, যেগুলো দেখলে হাতি আর সামনে এগোবে না।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।