বৈদ্যুতিক শকে চট্টগ্রামে আরেকটি হাতির মৃত্যু

কামরান রেজা চৌধুরী
2021.12.02
ঢাকা
বৈদ্যুতিক শকে চট্টগ্রামে আরেকটি হাতির মৃত্যু চট্টগ্রামের বাঁশখালিতে কৃষি জমিতে একটি হাতি মরে পড়ে থাকার খবরে আশেপাশের এলাকার বাসিন্দারা তা দেখতে ভিড় জমান। ১২ নভেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

বুনো হাতির কবল থেকে ফসল রক্ষার জন্য বসানো বৈদ্যুতিক শকে চট্টগ্রামে আরেকটি হাতি মৃত্যুর পর স্থানীয় তিন গ্রামবাসীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে বন বিভাগ।

বৃহস্পতিবার বন বিভাগের কর্মকর্তারা বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনের আওতায় চট্টগ্রাম আদালতে হাতি হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করেন বলে বেনারকে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সাতকানিয়া রেঞ্জের কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন।

তিনি জানান, গত ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের সাতকানিয়া অংশের জঙ্গলে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে হাতিটির মৃত্যু হয়। স্থানীয়রা ওই তার স্থাপন করেছিল।

দেশের বিভিন্ন স্থানে গত দুমাসে নিয়মিতভাবে হাতি মৃত্যুতে গভীর শঙ্কা প্রকাশ করে ২৯ নভেম্বরের সভায় হাতি রক্ষায় জরুরি ব্যবস্থা নিতে সরকারকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি পরামর্শ দেয়ার পরদিনই আরেকটি হাতি হত্যা করা হলো।

দেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত বন বিভাগের বন সংরক্ষক মোল্লা রেজাউল করিম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় যে হাতিটি মারা গেছে সেটিকে হত্যা করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক শক লেগে হাতিটির মৃত্যু হয়েছে বলে পোস্ট মর্টেম প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।

মোল্লা রেজাউল বলেন, এ বছর দেশে মোট ১২টি হাতি প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে ছয়টিকে হত্যা করা হয়।

“হাতিটি ৩০ নভেম্বর মারা যায়। বিষয়টি আমাদের নজরে আসে পহেলা ডিসেম্বর। ২ ডিসেম্বর আমরা হাতিটির মরদেহের পোস্ট মর্টেম করার ব্যবস্থা করি,” বেনারকে বলেন চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার কালিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন।ৱ

তিনি বলেন, “পোস্ট মর্টেম করার পর হাতিটি হত্যার দায়ে আজ বৃহস্পতিবার আমরা তিনজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেছি।”

যে স্থানে হাতিটি মারা গেছে সেই স্থানে ধানক্ষেতের পাশে যারা বৈদ্যুতিক তার স্থাপন করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন, ২০১২ অনুযায়ী হাতি হত্যা প্রমাণিত হলে হত্যাকারীর দুই বছর থেকে সাত বছর কারাদণ্ড বা এক থেকে দশ লাখ টাকা দণ্ড অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।

এই আইনের আওতায় দায়ের করা হাতি হত্যার মামলাটি অজামিনযোগ্য।

আইন অনুযায়ী, কোনো অপরাধী একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি করলে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

জীবন রক্ষার্থে কেউ হাতি হত্যা করলে এই আইন প্রযোজ্য হবে না।

অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়’

বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান হাতি হত্যার প্রতিবাদে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

হাতি রক্ষা করতে আদালতের শরণাপন্ন হয়ে দুই পরিবেশবাদী রিট আবেদন করলে গত ২২ নভেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ হাতি রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি নির্দেশ জারি করে।

গত ২৯ নভেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে হাতি হত্যার বিষয়ে আলোচনা হয়।

কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “যেভাবে আমাদের দেশে হাতি মারা যাচ্ছে সেটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। এগুলো যে কোনো মূল্যে হোক বন্ধ করতে হবে।”

তিনি বলেন, “আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি, যারা বৈদ্যুতিক তার বসিয়েছে তারাসহ পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির যেসব কর্মকর্তা বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করতে হবে।”

পরিবেশ ও বনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, তাঁর মন্ত্রণালয় স্থায়ী কমিটির পরামর্শ বাস্তবায়ন করবে এবং যারা বৈদ্যুতিক সংযোগ দিবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে।

বাংলাদেশে মূলত এশিয়ান এলিফ্যান্ট দেখা যায়। এগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট, শেরপুর ও ময়মনসিংহ জেলায় চলাফেরা করে।

বাংলাদেশ-ভারত পাহাড়ি সীমান্তবর্তী শেরপুরের শ্রীবর্দী ও ঝিনাইগাতি উপজেলা, কক্সবাজারের উখিয়ায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে বাংলাদেশ-ভারত উভয় অংশে চলাচল করে এশিয়ান এলিফ্যান্ট প্রজাতির এই হাতি।

২০১৬ সালে পরিচালিত এক জরিপে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এশিয়ান এলিফ্যান্টকে মারাত্মক সঙ্কটাপন্ন প্রাণী হিসাবে উল্লেখ করেছে।

এই জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে হাতির সংখ্যা সর্বোচ্চ ২৬৮টি।

এখানে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান মানুষের চাপে হাতির আবাসস্থল ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে এবং মানুষের সাথে হাতির সংঘাত বাড়ছে।

বিশ্বের মাত্র ১৩টি দেশে এশিয়ান এলিফ্যান্ট দেখা যায় এবং সারাবিশ্বেই এই প্রজাতি সঙ্কটাপন্ন।

আইইউসিএন এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি রাকিবুল আমিন বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “এটি খুবই দুঃখজনক, একের পর এক হাতি প্রাণ হারাচ্ছে। অনেক হাতিকে হত্যা করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের এখানে আর হাতি থাকবে না।”

তিনি বলেন, মানুষ-হাতি সংঘাত বন্ধে মূল সমস্যা সমাধান করতে হবে।

রাকিবুল বলেন, অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ হাতির জায়গা দখল করেছে। সেকারণেই সংঘাত। আবার অনেক সময় খাদ্য সংকটের কারণে হাতি গ্রামে ঢুকে পড়ে, এটিও সত্য।

সাতকানিয়া ইউনিয়নবাসী শামসুল আলম বেনারকে বলেন, “বন্যহাতির জ্বালায় আমাদের ফসল রাখা দায়। এরা দল ধরে এসে যতটুকু ফসল খায় তার চেয়ে বেশি নষ্ট করে। আমাদের বাড়িঘরে আক্রমণ চালায়।”

তিনি বলেন, “মানুষ বাধ্য হয়ে বৈদ্যুতিক তার বসায়। কেউ হাতিকে হত্যা করতে চায় না। আমরা চাই হাতিগুলো যেন আমাদের এদিকে না আসে।”

পরিবেশবাদীরা বলছেন, হাতিরা দল বেঁধে একটি নির্দিষ্ট করিডোরে অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট পথে চলাচল করে। আইইউসিএন এর মতে, বাংলাদেশে মূলত ১২টি হাতি চলাচলের করিডোর রয়েছে। সেগুলোর প্রায় সবগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।

সর্বশেষ কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির স্থাপন করার কারণে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে হাতির সাথে মানুষের সংঘর্ষ বেড়েছে।

খামার রক্ষার জন্য বৈদ্যুতিক তার বসায় গ্রামবাসীরা।

বন সংরক্ষক রেজাউল করিম মোল্লা বলেন, জনবল সংকটের কারণে বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানতে পারেন না কোথায় বৈদ্যুতিক তার বসানো হয়েছে। তারপরও বন বিভাগ এ ধরনের বেআইনি কাজ বন্ধের চেষ্টা করে যাচ্ছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।