জলবায়ু পরিবর্তন রোধ: নয় কোটি টন কার্বন নিঃসরণ কমাবে বাংলাদেশ
2021.09.08
ঢাকা
বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্বালানি পোড়ানোর কারণে আগামী নয় বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৪১ কোটি টন কার্বন নিঃসরণ হবে, যা জলবায়ুকে পরিবর্তন করবে মারাত্মকভাবে, এর মধ্যে শর্তহীনভাবে প্রায় দুই কোটি ৮০ লাখ টন কার্বন কমানোর আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার করেছে বাংলাদেশ।
তবে উন্নত প্রযুক্তি ও অর্থ সহায়তা পেলে আরো প্রায় সোয়া ছয় কোটি টন নিঃসরণ কমানো যাবে, সব মিলে যার পরিমাণ দাঁড়াবে নয় কোটি টন।
জাতিসংঘের জলবায়ু সংস্থা ইউএনএফসিসিসি’র কাছে জমা দেয়া ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কনট্রিবিউশন (এনডিসি) নামে পরিচিত এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কার্বন নিঃসরণ কমানোর এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার। প্রতিবেদনটি গত ২৬ আগস্ট জাতিসংঘে জমা দেয়া হয়, যার একটি কপি বেনারের হাতে রয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্লাইমেট সেলের পরিচালক মির্জা শওকত আলী মঙ্গলবার বেনারকে জানান, ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী জাতিসংঘের প্রত্যেকটি দেশকে নিজদের এনডিসিতে জানাতে হয় যে, কে কতটুকু কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারবে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে নির্গত হওয়া মোট ৪১ কোটি টন কার্বনের মধ্যে নিঃশর্ত এবং শর্ত সাপেক্ষে প্রায় নয় কোটি টন নিঃসরণ কমাতে পারবে বাংলাদেশ, যা মোট নিঃসরিত কার্বনের প্রায় ২২ শতাংশ।
বর্তমানে, বাংলাদেশে নিঃসরণ হওয়া কার্বনের অর্ধেকের বেশি আসে জ্বালানি খাত থেকে (৫৫ ভাগ)। এই খাতে নিঃসরণ কমাতে ২০৩০ সালের মধ্যে বাড়তি ৯১৮ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। পাশাপাশি, কয়লার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে বিদ্যমান গ্যাস চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের দক্ষতা বৃদ্ধি করা হবে বলেও জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।
দুটিই জীবাশ্ম জ্বালানি হলেও কয়লা পুড়িয়ে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়, গ্যাস পুড়িয়ে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে তার অর্ধেক নিঃসরণ হয় বলে বেনারকে জানান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম।
এছাড়া প্রচলিত প্রযুক্তিতে কয়লা পোড়ালে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয় উন্নত প্রযুক্তিতে তার চাইতে অনেক কম হয় বলেও জানান তিনি।
কার্বন নিঃসরণের আরেক খাত পরিবহন। শহরাঞ্চলে যানজটের কারণে যানবাহন রাস্তায় আটকে থাকে এবং অধিকাংশ গাড়ির ইঞ্জিন সচল থাকায় বাড়তি কার্বন নিঃসরিত হয়।
যানজট কমাতে শহরাঞ্চলের রাস্তাঘাট প্রশস্ত করা হবে এবং সড়ক পরিবহনের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে নদীপথের ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে এনডিসিতে। এতে গাড়ির সংখ্যা কমে কার্বন নিঃসরণ কমে আসবে।
এছাড়া ইটভাটাগুলোতে আগুন ছাড়া বিদ্যুতের মাধ্যমে ইট তৈরি চালু করে এই খাত থেকে ১৪ ভাগ কার্বন নিঃসরণ কমানো হবে বলেও জানানো হয়।
এর বাইরে কৃষিখাতে জ্বালানী তেলের পরিবর্তে সৌরপ্যানেল ব্যবহার এবং বর্জ্য থেকে মিথেন গ্যাস উদগিরণ কমাতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে এনডিসিতে জানানো হয়েছে।
বাড়তি নিঃসরণ কমাতে প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি ও অর্থায়ন
প্যারিস চুক্তির আগে বিদ্যমান কিয়োটো প্রটোকল অনুযায়ী উন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণ কমাতে বাধ্য ছিল কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না বলে বেনারকে জানান ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের উপ-পরিচালক অধ্যাপক ড. মিজান আর. খান।
“কিন্তু প্যারিস চুক্তিতে কারো জন্য বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। এটি একটি জেন্টেলমেনস এগ্রিমেন্ট অর্থাৎ ভদ্রলোকের চুক্তি,” বলেন তিনি।
এই চুক্তি অনুযায়ী, প্রত্যেক দেশ নিজদের এনডিসি জমা দেবার পাঁচ বছর পর এনডিসি অনুযায়ী দেশগুলো নিঃসরণ কমিয়েছে কি না তা বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করে দেখবেন বলে জানান তিনি।
প্যারিস সম্মেলনের আগে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএফসিসিসিতে বাংলাদেশ প্রথম এনডিসি জমা দেয় জানিয়ে অধ্যাপক মিজান বলেন, সেখানে শর্তহীনভাবে বছরে শতকরা পাঁচ ভাগ কার্বন নিঃসরণ কমানোর কথা বলা হয়েছিল।
আর প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং অর্থায়ন পাওয়া সাপেক্ষে আরো ১০ ভাগ নিঃসরণ কমানোর কথা বলা হয় সেখানে।
বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সংগঠন ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের চেয়ার বাংলাদেশ।
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অপচয় কমাতে পারলে বাংলাদেশে কমপক্ষে শতকরা ১০ ভাগ কার্বন নিঃসরণ কমানো যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে বাড়তি নিঃসরণ কমাতে উন্নত প্রযুক্তি এবং বাড়তি অর্থায়নের প্রয়োজন হবে।”
সারা বিশ্বে বাড়তি হারে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে পরিবেশে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরিত হয়ে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অ্যান্টার্কটিকা অঞ্চলের বরফ গলে সাগরে পানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জাতিসংঘের কারিগরি কমিটি বলছে, এই বাড়তি বরফ গলার কারণে বিশ্বের অনেক নিচু দেশ সাগরে তলিয়ে যাবে।
এছাড়া, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনকে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ বলে আখ্যায়িত করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সর্বশেষ আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সপ্তম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ বাংলাদেশ। সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বিরাট অংশ পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে জাতিসংঘের অধীনে সকল দেশ সর্বশেষ ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষর করে। যার অধীনে প্রত্যেক দেশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো এবং নবায়নযোগ্য উৎস থেকে জ্বালানি ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দেয়।
“সরকার যে এনডিসি জমা দিয়েছে, সেই অনুযায়ী নিঃসরণ কমানো সম্ভব এবং এই কমানোর ফলে আমাদের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে না,” মনে করেন অধ্যাপক ম. তামিম।
“সরকার কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে সাধারণ মানের প্রযুক্তির পরিবর্তে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণ প্রযুক্তির চেয়ে আলট্রা সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে শতকরা পাঁচ ভাগ কম কয়লা পোড়াতে হয়। ফলে এই প্রযুক্তিতে কার্বন নিঃসরণ কম হয়।
এনডিসি অনুযায়ী আরো ১৫ ভাগের বেশি নিঃসরণ কমাতে সৌর বিদ্যুতের দিকে জোর দিতে হবে বলে জানান তিনি।
নব্বই দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের চার ভাগের একভাগ সিস্টেম লসের নামে অপচয় হতো জানিয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বেনারকে বলেন, “সিস্টেম লস কমে বর্তমানে শতকরা নয় ভাগের কম।”
বাংলাদেশের “বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা খুব উন্নতমানের নয়,” জানিয়ে তিনি বলেন “উন্নত দেশের মতো সিস্টেম লস শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে আমাদের স্মার্ট গ্রিড স্থাপন করতে হবে।”
“আমরা যতটুকু বিদ্যুৎ উৎপাদন করি, এর সবটুকু যদি বিতরণ করতে পারতাম তাহলে পথিমধ্যে কোনো বিদ্যুৎ অপচয় হতো না; ফলে কম জ্বালানি পোড়াতে হতো, তাতে কার্বন নিঃসরণ কম হতো,” বলেন মোহাম্মদ হোসাইন।