সারাদেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট: পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার

কামরান রেজা চৌধুরী
2024.09.10
ঢাকা
সারাদেশে বিদ্যুৎ বিভ্রাট: পরিস্থিতি সামলাতে  হিমশিম খাচ্ছে সরকার লোডশেডিংয়ের সময়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছেন রাজধানীর পল্টন এলাকার একজন খাবারের দোকানদার। ঢাকা। ১০ সেপ্টেম্বর।
[মো: হাসান/বেনারনিউজ]।

দেশে বিদ্যুতের স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

গত কয়েকদিন ধরে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। চলছে ঘন্টার পর ঘন্টা লোডশেডিং।

ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘন ঘন দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য, কারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যার প্রভাব পড়বে দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ওপর।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জনসংযোগ বিভাগের পরিচালক মো. শামীম হাসান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, বর্তমানে সারাদেশে দৈনিক প্রায় ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কমপক্ষে দেড় হাজার মেগাওয়াট কম। সে কারণেই ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে।

তিনি বলেন, গ্যাস সঙ্কটের কারণে অভ্যন্তরীণ কেন্দ্র থেকে উৎপাদন কম হচ্ছে। এর মধ্যেই সোমবার সন্ধ্যা থেকে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণও কমে গেছে।

 

ভারত থেকে বিদ্যুৎ আসা কমেছে

ভারত থেকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ বিক্রি করা আদানি গ্রুপের কাছে ৮০ কোটি ডলার বকেয়া পড়েছে। ফলে তারাও সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে প্রায় ৪০০ মেগাওয়াট।

ভারতের অন্যান্য কেন্দ্র থেকেও বিদ্যুৎ আসছে কম।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) খন্দকার মোকাম্মেল হোসেন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, ভারতের আদানি গ্রুপ তাদের ঝাড়খন্ডের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বাংলাদেশকে এ বছর জুন থেকে দেড হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করত।

“এ ছাড়াও ভেড়ামারা সীমান্ত দিয়ে বহরমপুর থেকে এক হাজার মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ভারত থেকে আমদানি করা হতো,” জানান তিনি।

মোকাম্মেল হোসেন বলেন, “তবে ভারত থেকে সরবরাহ কমে গেছে। গত দুদিন থেকে আদানি গ্রুপ এক হাজার ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিচ্ছে। ভেড়ামারা দিয়ে ৮৫০ মেগাওয়াট এবং ত্রিপুরা থেকে ৭০ থেকে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসছে। সরবরাহ কমে আসার প্রভাব সার্বিক বিদ্যুৎ পরিস্থিতিতে পড়েছে।”

সরবরাহ কমার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের কাছে আদানি গ্রুপের ৮০ কোটি ডলার (৮০০ মিলিয়ন ডলার) বকেয়া রয়েছে। এই অর্থে পেতে তারা ইতোমধ্যে সরকারকে চিঠি দিয়েছে।”

মোকাম্মেল হোসেন বলেন, “আদানিকে আমরা কিছু অর্থ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। দেখা যাক কি করা যায়।”

 

কমেছে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন

মোকাম্মেল হোসেন বলেন, ৫২৫ মেগাওয়াটের বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন হতো প্রায় ২৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কারিগরি কারণে মঙ্গলবার সেখানকার উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বিভাগের তথ্য অনুসারে, দেশের উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ৪৩ ভাগের বেশি আসে গ্যাস-ভিত্তিক কেন্দ্র থেকে।

গত দুই মাস আগেও গ্যাস-ভিত্তিক কেন্দ্র থেকে প্রায় ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতো। গ্যাস সরবরাহের সমস্যার কারণে সেই উৎপাদন পাঁচ হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে।

মোকাম্মেল হোসেন বলেন, “সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভালো নয়। লোডশেডিং হচ্ছে।”

বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলীয় ১৬ জেলায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে বলে মঙ্গলবার বেনারকে জানান, সরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. জাকিউল ইসলাম।

মঙ্গলবার তিনি বেনারকে বলেন, “মানুষ বিদ্যুৎ চায়। তারা বোঝে না যে, আমি তো বিদ্যুৎ উৎপাদন করি না। আমি যা সরবরাহ পাই সেটাই সরবরাহ করি।”

জাকিউল ইসলাম বলেন, “বড়পুকুরিয়া বন্ধ হওয়ায় রংপুর বিভাগে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। এই বিভাগের জেলাগুলোর চাহিদা ৯৫০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে মঙ্গলবার দিনে সরবরাহ ছিল ৬৬৩ মেগাওয়াট।”

তিনি বলেন, “সে কারণে বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। রাতে এই বিভ্রাট আরও বৃদ্ধি পাবে। রাতে মানুষ আলো জ্বালাবেন। চাহিদা বৃদ্ধি পাবে।”

একইভাবে রাজশাহী বিভাগে চাহিদা এক হাজার ৩১৩ মেগাওয়াট; এর বিপরীতে সরবরাহ এক হাজার ১৪০ মেগাওয়াট বলে জানান জাকিউল ইসলাম।

 

ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র শিল্প

ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে কল-কারখানায় ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশে চেম্বার অব ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন।

তিনি বেনারকে বলেন, “বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভাল নয়। গত তবে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়েছে দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প যেখানে লাখ লাখ মানুষ কাজ করে।”

তিনি বলেন, “দেখবেন ধোলাইখালের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানাগুলো নাট-বোল্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করে। এগুলো আমাদের অন্যতম বড় কর্মসংস্থানের খাত। দিনের মধ্যে যদি পাঁচ ছয় বার বিদ্যুৎ গেলে তারা কিভাবে কারখানা চালাবে?”

মীর নাসির হোসেন বলেন, “একইসাথে বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধিতে সরকারকে নজর দিতে হবে। কারণ দেশের বড় শিল্পগুলো গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।”

তবে বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবাই নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

“পিডিবি অথবা পল্লী বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করে কারখানা চালানো যাবে না। সরবরাহ ঠিক নেই। ভোল্টেজ ভালো নয়,” বলেন নাসির হোসেন।

ঢাকার মগবাজার এলাকার আধুনিক মোটরসাইকেল ওয়ার্কসপ স্পিডো’র প্রধান জাবেদ আহমেদ মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “দিনে কয়েকবার বিদ্যুৎ চলে যায়। বিদ্যুৎ চলে গেলে গরমে কাজ করা যায় না। বিদ্যুতে চলা মেশিনগুলোর কাজ বন্ধ রাখতে হয়। কাজ হয় না, অথচ আমাকে তো কর্মীদের পয়সা দিতে হয়।”

 

জনজীবন অতিষ্ঠ

বিরামপুর মহিলা কলেজের শিক্ষিকা শেলি লতিফা খানম মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “গত কয়েকদিন ধরে কারেন্ট থাকেই না। আজকে পরিস্থিতি সবচে খারাপ মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর চলে যাচ্ছে।”

“দিনের মধ্যে চার-পাঁচবার কারেন্ট যাচ্ছে। একবার গেলে আধা ঘন্টা-দেড় ঘন্টা পর আসছে। কোনও নিয়ম নাই।”

রংপুরের টুকুরিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা ও স্কুল শিক্ষক আব্দুল মান্নান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার আগে থেকেই বিদ্যুৎ পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। বর্তমানে পরিস্থিতি খুব বেশি খারাপ। বিশেষ করে রাতে বিদ্যুৎ বেশি যায়। গরমে ঘুমানো কঠিন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।