গুম বিষয়ে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সই করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেন অধিকারকর্মীরা
2024.08.29
ঢাকা
বলপূর্বক গুম থেকে সকল ব্যক্তির সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সাক্ষর করেছে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন ও গুমের শিকার পরিবারগুলোর দীর্ঘদিনের একটি দাবি ছিল এটি।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বৃহস্পতিবার সকালে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় চুক্তিতে সাক্ষর করেন। এ সময় এই ঘটনাকে ‘একটি ঐতিহাসিক’ ঘটনা বলে উল্লেখ করেন বলে জানিয়েছে তাঁর প্রেস উইং।
২০০৬ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গুমবিরোধী সনদটি গৃহীত হয়। ৩২টি দেশ এটি অনুসাক্ষর করার পরে ২০১০ সালে তা বাস্তবায়ন শুরু হয়। দীর্ঘদিন ধরে জাতিসংঘ অনুরোধের জানিয়ে আসলেও গুমবিরোধী সনদে এতদিন সই করেনি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সরকার এমন এক সময় এই কনভেনশনে সই করলো যখন মাত্র একদিন পর ৩০ আগস্ট প্রতি বছরের ন্যায় এবারো জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হবে।
তার আগে মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করে সরকার।
মানবাধিকার সংস্থা এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের হিসাবে, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গুমের শিকার হয়েছেন ৫৫৩ জন। তাঁদের কেউ কেউ ফিরে এসেছেন। কেউ উদ্ধার হয়েছেন সীমান্তের ওপার থেকে। কারও লাশ পাওয়া গেছে পরে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলেছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৭ বছরে দেশে গুমের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৬২৯ জন।
গুমের শিকার এসব ব্যক্তির মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ৬২ জনকে, গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ৭৩ জনকে এবং এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ৩৮৩ জন।
মানবাধিকার সংগঠনটির হিসেবে দেশে সর্বাধিক গুমের ঘটনা হয়েছে ২০১৬ সালে, ৯৭ জন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই রাজনৈতিক কর্মী এবং ভিন্নমতাবলম্বী।
নাগরিকদের যেসব সুরক্ষা দিতে হবে
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো নাগরিকদের বেশ কিছু সুরক্ষা দিতে বাধ্য থাকবে।
এর মধ্যে রয়েছে, এটা নিশ্চিত করতে হবে যে ব্যতিক্রম ছাড়া কেউ জোরপূর্বক গুমের শিকার হবেন না, এমনকি যুদ্ধ বা অন্যান্য জন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থার সময়ও রাষ্ট্রপক্ষগুলি বলপূর্বক গুমের মতো অপরাধী জড়াবে না এবং এটিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে বাধ্য।
এত বলা হয়, বলপূর্বক গুম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান করতে, তাদের নিখোঁজ হওয়ার তদন্ত করতে এবং ভিকটিমদের ন্যায়বিচার ও ক্ষতিপূরণের সুযোগ দিতে রাষ্ট্রগুলি বাধ্য।
স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলি অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য পারস্পরিক আইনি সহায়তা এবং পরস্পরকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার জন্য বাধ্য, বলা হয় কনভেনশনের শর্তে।
এতে আরো বলা হয়, গোপন আটকে রাখা নিষিদ্ধ।
ইতিবাচক বলছেন অধিকারকর্মী ও ভিকটিমরা
জাতিসংঘের মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিকাশ ও সুরক্ষাবিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার আইরিন খান এক এক্স (সাবেক টুইটার) বার্তায় বাংলাদেশের এই পদক্ষেপের প্রশংসা করে বলেছেন, “জোরপূর্বক গুম নিরসনে এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার প্রতিশ্রুতি ও দায়বদ্ধতার দিকে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”
তিনি আরো বলেন, “আশা করি শিগগির বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানাবে।”
গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন মায়ের ডাকের সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি, এটা ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাদেশের জন্য আজকের এই দিনটি ঐতিহাসিক, এই দিনটি ঐতিহাসিক গুমের শিকার পরিবারগুলোর জন্য।
“আমরা দীর্ঘদিন ধরে আমাদের পরিবারের সদস্যদের কোন খোঁজ না পেয়েও আইনি কোনও পদক্ষেপ নিতে পারিনি শুধুমাত্র এখানে আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে। গুম থেকে নাগরিকের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক কনভেনশনে অন্তর্ভুক্তির চুক্তিতে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করায় আমাদের জন্য আইনি সুরহা পাওয়ার নানা দ্বার উন্মুক্ত হলো,” বলেন তিনি।
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা পতনের পর এখন পর্যন্ত মাত্র তিন জনের সন্ধান মিলেছে জানিয়ে সানজিদা বলেন, “এখনো শতাধিক মানুষ নিখোঁজ। গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগের শাসনামলে একের পর এক মায়ের বুক খালি হয়েছে, সন্তানরা পিতৃহারা হয়েছে... এখন আমরা একটি নতুন অধ্যায়ের দিকে যেতে পারবো।”
আন্তর্জাতিক এই কনভেনশনটিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছেন জানিয়ে সানিজদা ইসলাম বলেন, “গুমের জন্য এতোদিন দেশে কোন আইনি ব্যবস্থা ছিল না, আমাদেরকে সাধারণ ডায়েরি করেই বসে থাকতে হয়েছে বছরের পর বছর। এখন নিশ্চয়ই ইতিবাচক কিছু ঘটবে বলে আমাদের বিশ্বাস।”
২০১৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত গুম ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী মো. সোহেল রানা।
তিনি বেনারকে বলেন, “আন্তর্জাতিক এই কনভেনশনটিতে সাক্ষরের মধ্যে দিয়ে এখন থেকে বাংলাদেশে শুধুমাত্র বাংলাদেশের নয় সারা পৃথিবীর সকল দেশের গুমের ঘটনায় সুরক্ষা প্রদানকারী একটি দেশের তালিকায় প্রবেশ করলো।”
সোহেল রানা মনে করেন, এই কনভেনশনে প্রবেশের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বার বার অনুরোধ করা হলেও বাংলাদেশ এতোদিন তা করেনি। কারণ, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গুমকে নিপীড়নের একটি হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
সরকারের অবস্থান কঠোর
চলতি সপ্তাহের শুরুর দিকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাবসহ সরকারি বাহিনীর যে সদস্যরা ‘গুম, খুন, নির্যাতনের মত অপরাধে যুক্ত ছিলেন, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া হবে। এরপর সরকার কমিশন গঠন করে।
কমিশন গঠন সম্পর্কে জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, বছরের পর বছর গুমের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা দেশে ঘটেছে। এই ভয়াবহতম ঘৃণ্য কাজটিকে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
“আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে রাজনৈতিক যেসব নেতৃত্ব এবং অন্যান্য পর্যায়ের ব্যক্তি গুমের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে,” বলেন তিনি।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বেনারকে বলেন, “জোরপূর্বক গুমের প্রতিটি ঘটনা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা হবে এবং যারা প্রকৃতই জড়িত তাদের বিচার করা হবে। কোনও অবস্থাতেই নিরপরাধ কোন ব্যক্তি বা রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে হয়রানির সুযোগ থাকবে না।”
এইচআরডব্লিউ’র আহ্বান
এক বিবৃতিতে বৃহস্পতিবার শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে গুমের সকল ঘটনা তদন্তের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত নতুন কমিশন তদন্তের জন্য সরকারকে জাতিসংঘের কাছ থেকে দক্ষতা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন গুমকে সরকার করলেও বর্তমান সরকার গুমকে স্বীকৃতি দেয়ার ঘটনা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ উল্লেখ করে বিবৃতিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়ার পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, “এই তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে গুমের শিকার ব্যক্তিদের এবং তাদের পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।”