শিয়াল মারতে গিয়ে বিষ প্রয়োগ, মরল ‘মহাবিপন্ন’ ১৩ টি বাংলা শকুন

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.03.24
ঢাকা
শিয়াল মারতে গিয়ে বিষ প্রয়োগ, মরল ‘মহাবিপন্ন’ ১৩ টি বাংলা শকুন উড়ন্ত এই শকুনের ছবিটি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড এলাকা থেকে তোলা। ৩ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[বেনারনিউজ]

শিয়াল মারতে মৃত ছাগলের গায়ে বিষ ঢেলেছিলেন দুই গ্রামবাসী। সেই ছাগলের মাংস খেয়ে শিয়াল মরেছে ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে মারা গেছে বিপন্ন ১৩ টি শকুন।

পরিবেশবাদীদের মতে, গত দুই দশকে একসঙ্গে এত সংখ্যক বিপন্নপ্রায় বাংলা শকুনের (হোয়াইট র‍্যাম্পড ভালচার) প্রাণ হারানোর ঘটনা আর ঘটেনি।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একটি গ্রামে এই ঘটনা ঘটেছে। বন বিভাগের এক কর্মকর্তা বাদী হয়ে মৌলভীবাজার সদর থানায় এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তবে শুক্রবার পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি।

বন বিভাগের মৌলভীবাজার সদর রেঞ্জের আওতায় বর্ষিজোড়া বিট অফিসার আবু নাঈম মো. নুরুন্নবী লিখিত অভিযোগে জানান, ২২ মার্চ রাতে তিনি জানতে পারেন যে, একটোনা ইউনিয়নের বড় কাপন মাঠের কাছে ১৩টি মৃত বাংলা শকুন পড়ে আছে।

ঘটনাস্থলে শিয়ালের মাথার কঙ্কাল ও মৃত শিয়াল, চারটি মৃত কুকুর এবং দুটি বিষের কৌটা পাওয়ার কথা জানান তিনি।

স্থানীয় বাসিন্দাদের বরাত দিয়ে অভিযোগপত্রে বলা হয়, বড় কাপন গ্রামের মো. রোকন ও কচনু মিয়ার পালিত ছাগল মেরে ফেলে কয়েকটি বন্য শিয়াল। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিয়াল মারতে তাঁরা মৃত ছাগলের শরীরে বিষ ছিটিয়ে দেন। এরপর মৃত ছাগলের মাংস খেয়ে ১৩টি বাংলা শকুনসহ কয়েকটি কুকুর ও শিয়াল মারা যায় বলে ধারনা করা হচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) লাল তালিকা অনুযায়ী, এই শকুন “মহাবিপন্ন পাখি” এবং বাংলাদেশে এর সংখ্যা মাত্র ২৬০টি। এই শকুন বিলুপ্ত হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। কাজেই এই অপরাধের উপযুক্ত বিচার হওয়া উচিত।

মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কর্মকর্তা গোলাম সারোয়ার শুক্রবার বেনারকে বলেন, “ঘটনাস্থল থেকে দুটি কীটনাশকের বোতল উদ্ধার করা হয়েছে।”

তবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী এই অপরাধ ‘নন-কগনাইজেবল’ (আমলযোগ্য নয়)। হওয়ায় পুলিশ এখনই কাউকে আটক করতে পারবে না বলে শুক্রবার বেনারকে জানান মৌলভীবাজার সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ চৌধুরী।

তিনি বলেন, “বৃহস্পতিবার থানায় একটি ডায়েরি হয়েছে। আমরা শকুনগুলো ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়েছি। প্রতিবেদন প্রস্তুত হলে আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

এই ঘটনায় “বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, ২০১২ এর ৩৮(১) ধারা অনুসারে মামলা হতে পারে,” বলে জানান হারুনুর রশীদ।

উল্লেখ্য এই ধারা অনুযায়ী, পাখি হত্যার সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড।

একটি বিরাট ট্র্যাজেডি’

প্রসঙ্গত, শকুনকে প্রকৃতির ঝাড়ুদার বলা হয়। কোনো অঞ্চলে পশু মারা গেলে শকুন তা খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখে। গত দুই দশকে দেশ থেকে শকুন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কারণ হিসাবে বলা হয়, বিশেষ করে গরুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয় ডাইক্লোফেনাক নামক ব্যথানাশক ভেটেরিনারি ওষুধ।

পশু চিকিৎসকেরা বলে আসছেন, এই ওষুধ সেবন করা মৃত গবাদিপশুর মাংস খেলে শকুন কিডনি বিকল হয়ে মারা যায়। শকুন রক্ষায় সরকার ২০১০ সালের অক্টোবরে ডাইক্লোফেনাক ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে। তবে শকুনের সংখ্যা তেমন বৃদ্ধি পায়নি।

আইইউসিএন-এর শকুন সংরক্ষণ কর্মসূচির মুখ্য গবেষক সারোয়ার আলম দীপু শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশে যে শকুন রয়েছে সেটির নাম বাংলা শকুন। শকুন সংরক্ষণের অংশ হিসেবে আমরা জিপিএস’র মাধ্যমে শকুনগুলোর চলাচল পর্যবেক্ষণ করি। গত কয়েকদিন ধরে দেখছিলাম এগুলো একই জায়গায় রয়েছে। এতে আমাদের সন্দেহ হয়। পরে সেখানে গিয়ে দেখি শকুনগুলো মরে পড়ে আছে।”

“আমাদের সন্দেহ কালারবাজার এলাকার সব শকুনই মারা গেছে। এটি আমাদের জন্য একটি বিরাট ট্র্যাজেডি,” বলেন দীপু।

তিনি বলেন, “যিনি মৃত ছাগলে বিষ প্রয়োগ করেছেন তিনিও জানতেন না যে এর ফলে শকুন মারা যেতে পারে এবং শকুন এত গুরুত্বপূর্ণ।”

দীপু বলেন, “এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে আমরা বিভিন্ন এলাকার মসজিদে পশু-পাখি মারতে বিষ প্রয়োগ না করার আহ্বান জানাচ্ছি। তাছাড়া, এই ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে এলাকায় এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে।”

তিনি জানান, বিশ্বে এই শকুনের সংখ্যা সাড়ে ১১ হাজার। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, কম্বোডিয়াসহ এশিয়ার দেশগুলোতে এই প্রজাতির শকুন দেখা যায়। বাংলাদেশে এর মোট সংখ্যা ছিল ২৬০টি।

তিনি আরও জানান, ২০১৪ সাল থেকে এই শকুনের সংখ্যা স্থিতিশীল ছিল। বাংলাদেশের মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চলে সর্বোচ্চ একশ শকুন রয়েছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল। এখানে ৬০ থেকে ৮০টি শকুন রয়েছে।

সরকার যখন শকুন রক্ষায় নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তখনই এই খারাপ খবর পরিবেশবাদীদের হতাশ করেছে।

আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস ২০২২ উপলক্ষে গত ৩ সেপ্টেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশ ‘জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি’ গঠন করেছে। সরকারিভাবে দুটি শকুন নিরাপদ অঞ্চল ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া দশ বছর (২০১৬-২০২৫) মেয়াদি ‘বাংলাদেশ শকুন সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা’ বাংলাদেশের শকুন রক্ষা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদী কাঠামো হিসেবে কাজ করছে।

শকুন রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে এগিয়ে দাবি করে মন্ত্রী বলেন, শকুন সংরক্ষণে দীর্ঘমেয়াদী বিজ্ঞানভিত্তিক যে কোনও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে আসলে তা বাস্তবায়নে সহায়তা করা হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।