বাংলাদেশের পোশাক শিল্প: কমছে ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ ও পরিবেশ দূষণ

রিয়াদ হোসেন
2023.06.16
ঢাকা
বাংলাদেশের পোশাক শিল্প: কমছে ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ ও পরিবেশ দূষণ পরিবেশ বান্ধব কারখানার স্বীকৃতি পাওয়া ঢাকার ফোরএ ডাইয়িং লিমিটেডে কাজ করছেন শ্রমিকরা। ২৬ জুন ২০২২২।
[বেনারনিউজ]

পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাত অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে। এর ফলে কারখানাগুলোতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে বলে জানিয়েছেন শিল্প উদ্যোক্তা ও খাত সংশ্লিষ্টরা।

চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশে গত এক দশকে প্রায় ২০০ কারখানা পরিবেশবান্ধব হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আরও প্রায় ৪০০ কারখানা এই প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) লিডারশিপ অন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন বা লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানার সংখ্যায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন শীর্ষে।

এছাড়া পরিবেশবান্ধব বিবেচনায় বিশ্বের শীর্ষ ১০টি কারখানার আটটির অবস্থানই বাংলাদেশে।

14 BD-garment2.jpeg
ঢাকার অদূরে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের সনদপ্রাপ্ত প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানার অভ্যন্তর। [সৌজন্যে: প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেড]

কমছে পরিবেশ দূষণ, হচ্ছে সাশ্রয়

ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের কাশীপুর ইউনিয়নে অবস্থিত দেশটির শীর্ষস্থানীয় পরিবেশবান্ধব হিসেবে স্বীকৃত কারখানা প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক জানান, এক দশক আগে দেশের পোশাক খাতের সবচেয়ে বড়ো বিয়োগান্তক ঘটনাটি তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে।

তিনি বেনারকে বলেন, “২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর (যেখানে এক হাজার ১০০ জনের বেশি শ্রমিক নিহত হন) ক্রেতা দেশগুলোতে আমাদের পোশাক খাত নিয়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা হয়। তখন আমি ভাবলাম, বিশ্ববাজারে আমাদের পোশাক খাতের ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে হবে। এ লক্ষ্যে আমি এই কার্যক্রমটি শুরু করি এবং ২০১৫ সালে আমরা এই স্বীকৃতি পাই।”

অবশ্য তারও আগে কয়েকটি কারখানা পরিবেশবান্ধব স্বীকৃতি পেয়েছিল।

তিনি বলেন, “পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে আমরা ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে পারছি। সেই সঙ্গে পানি সাশ্রয় হচ্ছে ৪২ শতাংশ আর ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারছি প্রায় ৩৫ শতাংশ।”

“শুধু তাই নয়, বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা থাকায় বাংলাদেশের পোশাক খাত সার্কুলার ফ্যাশন বা ঝুট কাপড় দিয়ে পুনরায় সুতা ও কাপড় তৈরি এবং সেখান থেকে পোশাক তৈরিতে ঝুঁকছে। এমনকি প্লাস্টিক বর্জ্য থেকেও ফাইবার এবং কাপড় তৈরি হচ্ছে এখানে,” বলেন তিনি।

“আমরা কোনো কোনো ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী, ২০ শতাংশ রিসাইকেল ফাইবারের মিশ্রণে পোশাক (মূলত ডেনিম প্যান্ট) তৈরি করছি। স্থানীয় টেক্সটাইল মিল থেকে আমরা এ ধরনের কাপড় সংগ্রহ করছি,” বলেন চট্টগ্রামভিত্তিক ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ওয়াশ বিভাগের প্রধান) তিতাস চক্রবর্ত্তী।

পরিবেশবান্ধব কারখানার কারণে এলাকার পরিচিতিও বাড়ছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। প্লামি ফ্যাশনস কারখানা এলাকার অধিবাসী ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শামীম আহাম্মদ বলেন, “এই কারখানার বর্জ্য স্থানীয় খাল বা নদীতে যায় না। অন্যান্য ডায়িং ও ওয়াশিং কারখানাও (পরিবেশবান্ধব হিসেবে স্বীকৃত নয় এমন) এখন ইটিপি বা বর্জ্য শোধনাগার ব্যবহার করছে। ফলে সার্বিকভাবে দূষণ ও দুর্গন্ধ কিছুটা হলেও কমেছে।”

নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “অনেক ছোট আকারের কারখানা পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে মানছে না।”

“তবে এই এলাকায় ৩৩০টি কারখানা ইটিপি ব্যবহার করছে, যার বেশির ভাগই ডায়িং ও ওয়াশিংয়ে যুক্ত। ফলে এসব কারখানা সংলগ্ন নদীর দূষণ কমে এসেছে,” বলেন তিনি।

কিছু কারখানা নিয়মিত ইটিপি ব্যবহার করে না, বিশেষত রাতে—উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এসব কারখানাকে এই সময়ে তদারক করাও কঠিন। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে গত মে পর্যন্ত ২২টি কারখানার পরিষেবা (বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ) বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে।”

14 BD-garment3.jpg
পরিবেশ বান্ধব কারখানার স্বীকৃতি পাওয়া ঢাকার ফোরএ ডাইয়িং লিমিটেডের ভেতরে উৎপাদন পর্যবেক্ষণের জন্য স্থাপন করা ভিডিও মনিটর। ২৬ জুন ২০২২২। [বেনারনিউজ]

বর্জ্য থেকে কাপড় তৈরির উদ্যোগ

বিজিএমইএ’র সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম জানান, বাংলাদেশে বছরে যে পরিমাণ গার্মেন্টস ঝুট তৈরি হয়, তার দাম প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার।

তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা যদি এই ঝুটকে সঠিকভাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে সুতা, কাপড় ও পোশাক তৈরির মাধ্যমে মূল্য সংযোজন করতে পারি, এটি বছরে বাড়তি প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি করবে। এটি আমাদের পরিবেশের জন্যও সহায়ক হবে।”

তিনি বলেন, “চারটি টেক্সটাইল মিল এ ধরনের বর্জ্য থেকে কাপড় তৈরির কাজ শুরু করেছে।”

স্পেনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রিকোভারের সহযোগিতায় দেশের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি বেক্সিমকো লিমিটেডের পোশাক ও টেক্সটাইল কারখানা ঝুট কাপড় থেকে সুতা ও কাপড় তৈরির কার্যক্রম শুরু করেছে।

এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে রিকোভারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তির সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ করলেও প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

সরকার কারখানা মালিকদের এ ধরনের উদ্যোগে সহায়তা দিতে এগিয়ে আসছে। গত জুনের শুরুতে প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল ঝুট কাপড় থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে সুতা উৎপাদনে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) অব্যাহতির ঘোষণা দিয়েছেন।

14 BD-garment4.jpg
ঢাকার ফোরএ ডাইয়িং লিমিটেডের বাইরের দেয়ালে পরিবেশ বান্ধব কারখানার স্বীকৃতির স্মারক টানিয়ে রাখা হয়েছে। ২৬ জুন ২০২২২। [বেনারনিউজ]

শ্রমিকরাও খুশি

হেলেনা আক্তার নামে প্লামি ফ্যাশনসের এক শ্রমিক কারখানা ভেতরের কাজের পরিবেশ নিয়ে নিজের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন।

“এই কারখানায় যুক্ত হওয়ার আগে আমি একটি কারখানায় (সাধারণ) কাজ করতাম। সেখানে এক লাইনে (উৎপাদন লাইন যেখানে ৭০ থেকে ৮০ জন শ্রমিক থাকেন) মাত্র দুই-তিনটা ফ্যান থাকতো। যে জন্য গরম বেশি থাকতো। এই কারখানায় কাজ করে গরম তুলনামূলক কম লাগে।”

ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেড নামে নারায়ণগঞ্জের কারখানার শ্রমিকরাও তাপমাত্রা নিয়ে সন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন। কারখানাটি ২০২২ সালে শীর্ষ পরিবেশবান্ধব নিট পোশাক কারখানা হিসেবে লিড সনদ পেয়েছে।

ওই কারখানার ২৭ বছর বয়সী শ্রমিক আসমা আক্তার কলি বেনারকে বলেন, “কারখানার ভেতরে আসলে মন ভালো হয়ে যায়। কারণ এখানে সবুজ ঘাস, পুকুর আছে।”

এর আগে একটি কারখানায় কাজ করতেন নিপা। তিনি বলেন, “কারখানার ভেতরে এয়ারকুলার ব্যবস্থা থাকায় কাজের সময় গরম কম লাগে।”

“এই কারখানা থেকে চাকরি না গেলে একই বেতনে আমি অন্য আরেকটি সাধারণ কারখানায় যাব না,” বলেন তিনি।

উৎপাদক ও ক্রেতার যৌথ অংশগ্রহণ

বাংলাদেশের একক ব্র্যান্ড হিসেবে সবচেয়ে বড়ো ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যঅন্ডএম টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থায় বিজিএমইএ’র সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করবে। এ লক্ষ্যে গত ৩১ মে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হেলেনা হেলমারসন বিজিএমইএ’র সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছেন।

এক মেইলের জবাবে প্রতিষ্ঠানটির মিডিয়া রিলেশনের প্রতিনিধি ইনিগো সিঞ্জ মিস্টার বেনারকে বলেন, “সার্কুলার ও পরিবেশবান্ধব পোশাক খাতের লক্ষ্যে উভয় প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করবে। আমাদের লক্ষ্য হলো ২০৪০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ থেকে বেরিয়ে আসা।”

প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, “এ লক্ষ্যে কারখানার কৌশলগত পথনকশা তৈরি, সবুজ কারখানা হিসেবে রূপান্তরে সহায়ক নীতি তৈরিতে যৌথভাবে কাজ করা হবে।”

“এছাড়া বস্ত্রশিল্পের বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করতে শিল্প সংশ্লিষ্ট নীতিমালার উন্নয়ন করা এবং গবেষণা ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হবে।”

বিজিএমইএ’র সহসভাপতি মিরান আলী জানান, এ কার্যক্রম আরও বেগবান হবে।

তিনি বেনারকে বলেন, “অন্যান্য ব্র্যান্ডও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।