বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই পলিথিন নিষিদ্ধ করায় ক্রেতাদের অসন্তোষ

অয়ন আমান
2024.10.01
ঢাকা
বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই পলিথিন নিষিদ্ধ করায় ক্রেতাদের অসন্তোষ মঙ্গলবার থেকে ঢাকার সুপার শপগুলোতে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও রাজধানীর সাধারণ বাজারে এ ধরনের ব্যাগ ব্যবহার হচ্ছে, যা আগামী ১ নভেম্বর থেকে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে সরকার। ছবিটি রাজধানীর সেগুনবাগিচা কাঁচা বাজার থেকে তোলা। ০১ আগস্ট ২০২৪।
[সনি রামানী/ বেনারনিউজ]

পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন নিষিদ্ধের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বিকল্প ব্যবস্থা না করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা কঠিন বলে মত দিয়েছেন পরিবেশবাদী ও সচেতন নাগরিকেরা।

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, মঙ্গলবার থেকে ঢাকার সুপার শপগুলোতে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে। আগামী ১ নভেম্বর থেকে সারা দেশে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। সেদিন থেকে পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালনা করবে সরকার।

মঙ্গলবার সরেজমিন ঢাকার বিভিন্ন সুপার শপে কেনাকাটা করতে গিয়ে ক্রেতাদের বিরক্তি প্রকাশ করতে দেখা যায়। একদিকে পলিথিন ব্যাগের বিকল্প ছিল না, অন্যদিকে পাট বা কাপড়ের ব্যাগ থাকলেও তার দাম ছিল অন্তত ১৬ টাকা।

ঢাকার সেগুনবাগিচায় আগোরা সুপার শপের ক্রেতা নাফিস আরমান বেনারকে বলেন, “পলিথিন ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে এখন পলিথিন নিষিদ্ধ হওয়ায় ক্রেতাকে ১৬-২০ টাকা খরচ করে পাটের ব্যাগ কিনতে হচ্ছে। এটার দাম কমাতে হবে। যাতে ক্রেতা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।”

আরেক ক্রেতা স্বপন সিকদার বেনারকে বলেন, “আজ প্রথম দিন, বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে আসতে মনে ছিল না। যে কারণে কয়েকটি ব্যাগ কিনতে বাড়তি ৬৪ টাকা খরচ হয়েছে।”

“ব্যাগের মূল্যটা আমার কাছে একটু বেশি মনে হয়েছে। এখন একটা ব্যাগ ১৬ টাকা রাখছে, সরকার এটা ১০ টাকার মধ্যে নামিয়ে আনতে পারলে ক্রেতাদের গায়ে লাগবে না। ব্যাগগুলো একাধিকবার ব্যবহারের মতো টেকসই করতে হবে।”

তবে বড়ো আকারে উৎপাদনে গেলে পাটের ব্যাগের দাম কমে আসবে বলে বেনারকে জানান সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।‌

তিনি বলেন, "পাটের ব্যাগ বারবার কিনতে হবে না। একটি ব্যাগ বারবার ব্যবহার করা যায়।"

রাজধানীর বিভিন্ন সুপার শপে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ আনতে ক্রেতাদের উদ্দেশ্য বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, "বাজার করার সময় আপনি আপনার ব্যাগ নিয়ে আসুন অথবা পরিবেশবান্ধব একাধিকবার ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ কিনে বাজার করুন।"

আগে মাছ, মাংসসহ কাঁচা পণ্য বিতরণে পলিথিন ব্যবহার হলেও মঙ্গলবার কাগজের ঠোঙায় এসব সামগ্রী দিতে দেখা যায় সুপার শপগুলোতে।‌

ঢাকার গ্রিন রোডের একটি সুপার শপ থেকে ১৬ টাকায় পাটের ব্যাগ কিনে বাজার করছিলেন গৃহিণী স্বর্ণা আক্তার। তিনি বেনারকে বলেন, "পলিথিনের চেয়ে এই পাটের ব্যাগ ভালো।"

সুপার শপ স্বপ্ন এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাব্বির হাসান নাসির বেনারকে বলেন, "পণ্য বহন করার জন্য পরিবেশবান্ধব ব্যাগ নিয়ে আসতে আমরা ক্রেতাদের অনুরোধ করছি। তাছাড়া গ্রাহকদের সুবিধার জন্য বেশকিছু ব্যাগ সুলভমূল্যে স্টোরে রেখেছি। কেউ বাসা থেকে ব্যাগ না আনলে স্টোর থেকে কিনে নিতে পারবেন।”

নাসির বলেন, "গ্রাহকদের এই ব্যাগ বারবার ব্যবহার করারও অনুরোধ করা হচ্ছে।"

প্রতিযোগিতায় দাম কমবে

পাটের ব্যাগ উৎপাদন নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে বলে বেনারকে জানান সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন।

তিনি বলেন, “যারা সুপার শপে কেনাকাটা করতে যান, তাদের জন্য ১০ টাকা বা ২০ টাকা বড়ো ব্যাপার নয়। এই পাটের ব্যাগ একাধিকবার ব্যবহার করা যায়। যখন পাটের ব্যাগের ব্যবহার বেড়ে যাবে তখন উৎপাদনে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে। সে সময় দামও কমে আসবে।”

সংশ্লিষ্টরা জানান, ধীরে ধীরে পলিথিন এতটাই বিপর্যয় ডেকে আনে যে, পরিবেশবাদীদের দাবি মুখে সরকার এর ব্যবহার ও উৎপাদন নিষিদ্ধ করে।

২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে এর উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ ও ব্যবহারকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়। তবে শুরুর দিকে বেশ কড়াকড়ি হলেও ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যায় আইনের প্রয়োগ। এরপর দেশের সর্বত্র আবার পলিথিনের ব্যবহার শুরু হয়।

অংশীজনদের নিয়ে বাস্তবায়ন

“দেশে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সরকারের এই সিদ্ধান্ত ইতিবাচক। তবে শপিংমল, কাঁচাবাজার, নাগরিক, পলিথিন উৎপাদনকারী ও সকল অংশীজন মিলেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হবে,” বেনারকে বলেন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের (পরিজা) সভাপতি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান।

তিনি বলেন, “ব্যাগ নিয়ে বাজারে যাওয়ার জন্য আমাদের নাগরিকদের অভ্যস্ত করে তুলতে হবে।”

“২০০২ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার যখন পলিথিনের বন্ধ করেছিল তখন মানুষ বাজারে ব্যাগ নিয়ে যাওয়া শুরু করে,” বলেন আবদুস সোবহান।

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বাসিন্দা মো. তমিজ উদ্দিন ভূইয়া (৭২) মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, "আমরা দেশ স্বাধীনের আগে ও পরে বাজারে ব্যাগ নিয়ে যেতাম। পাটের ব্যাগ বা সিমেন্টের বস্তা থেকে বানানো ব্যাগ।"

“আশির দশকে বাজারে গেলে পলিথিনে জিনিসপত্র দেওয়া শুরু হলো। পলিথিন দেয়ার জন্য টাকা নিত না। তারপর থেকে বাজারে আর ব্যাগ নিয়ে যাওয়ার অভ্যাস নেই। পলিথিনেই সব আনা হয়,” বলেন তিনি।

দিনে উৎপাদন এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে ‘বাংলাদেশের প্লাস্টিক দূষণের চিত্র নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফ্রন্টিয়ার্স অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং নামক জার্নাল।

এতে বলা হয়, বাংলাদেশে প্রায় তিন হাজার কারখানায় প্লাস্টিক ও পলিথিন তৈরি হয়। এসব কারখানায় দিনে ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হয়।

ওই গবেষণায় আরও বলা হয়, দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীর বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়ে। এতে সাগরের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে।

গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকার চারপাশের নদীগুলোতে জরিপ চালিয়ে ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পাওয়া গেছে। ওই বর্জ্য গত কয়েক যুগে জমা হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।