আইন কঠোর করছে ইইউ, প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের বহিষ্কার শিগগির

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.02.10
ঢাকা
আইন কঠোর করছে ইইউ, প্রত্যাখ্যাত আশ্রয়প্রার্থীদের বহিষ্কার শিগগির স্প্যানিশ এনজিও ওপেন আর্মস লাইফগার্ড বাংলাদেশিসহ প্রায় ৪০০ অভিবাসীকে ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করার পর তাঁরা ইটালির সিসিলির মেসিনা বন্দরে নামার আগে জাহাজে অপেক্ষা করছেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২।
[এপি]

নিরাপদ দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ, তুরস্ক ও তিউনিসিয়া থেকে যেসব নাগরিক ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে আশ্রয় প্রার্থনা করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন, তাঁদের সহজে বহিষ্কার করতে আইন কঠোর হচ্ছে।

শুক্রবার ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসালা ফন ডার লিয়েন আইন কঠোর করার ঘোষণা দেন।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের কারণে ইউরোপীয় দেশগুলোতে শরণার্থী সংকট বেড়ে যাওয়ায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

সংস্থাটি তাদের প্রতিবেদনে জানায়, আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন শেষ হলেও খুব কম সংখ্যক অবৈধ অভিবাসী ফিরে যান। 

অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে প্রায় ৬৫ হাজার বাংলাদেশি অবৈধভাবে প্রবেশ করেছেন।

বাংলাদেশিরা যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ লিবিয়ায় গিয়ে সেখান থেকে নৌকায় চেপে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইতালি ও গ্রিসে যান। সেখানে গিয়ে বাংলাদেশ অনিরাপদ দাবি করে আশ্রয় প্রার্থনা করে বছরের পর বছর অবস্থান করেন।

এ প্রসঙ্গে শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন “বাংলাদেশ কখনই অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া সমর্থন করে না; উৎসাহিত করে না।”

তিনি বলেন, “ইউরোপে যেসব বাংলাদেশি নাগরিক অবৈধভাবে অবস্থান করছেন অথবা শরণার্থী হিসেবে যাঁদের আবেদন বাতিল হয়ে গেছে, নাগরিকত্ব প্রমাণ সাপেক্ষে তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার কাজ করবে।”

“ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিজার) রয়েছে, যার আওতায় বেশ কয়েক হাজার বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে,” জানিয়ে তিনি বলেন, “সুতরাং, ইউরোপীয় ইউনিয়ন অভিবাসন আইন কঠোর করছে—এমন বিষয়ে নতুন করে মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই।”

কোভিডের পর ইউরোপ যাত্রায় শীর্ষ তিনে বাংলাদেশ

ইউরোপীয় ইউনিয়নের হিসাবে, ২০২০ সাল পর্যন্ত চার লাখ ৫৬ হাজারের বেশি বাংলাদেশি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে বসবাস করতেন। যাঁদের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ পুরুষ এবং একটি বড়ো অংশ অবৈধভাবে সেখানে গিয়ে থেকে গেছেন।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন শাখার প্রধান শরিফুল হাসান শুক্রবার বেনারকে বলেন, “২০১৫ সালে সিরিয়া থেকে লাখ লাখ শরণার্থী ইউরোপীয় দেশগুলোতে ঢুকে পড়তে শুরু করলে এই অবস্থার সুযোগ নেয় আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারীরা। তারা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের শরণার্থী হিসেবে ইউরোপে ঠেলে দেয়।”

তিনি বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারির পর বিশ্বের যে ক’টি দেশ থেকে অবৈধ পথে মানুষ ইউরোপীয় দেশগুলোতে গেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ তিনের মধ্যে রয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, গত ১৩ বছরে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ৬৫ হাজার মানুষ অবৈধ পথে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছে।”

“আমরা গবেষণা করে দেখেছি, এসব মানুষ মোট ১৮টি পথে ইউরোপে প্রবেশ করে। বেশির ভাগ বাংলাদেশি লিবিয়া থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি ও গ্রিসে যায়। সেখান থেকে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে,” বলেন শরিফুল।

তিনি আরও বলেন, “অবৈধভাবে ইউরোপে গেছেন এমন মানুষের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ঢাকা, কিশোরগঞ্জসহ সর্বোচ্চ ১০টি জেলার মানুষের সংখ্যা বেশি।”

ব্র্যাক এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা দু’টি প্রকল্পের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় তিন হাজার অবৈধ বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনেছে বলে জানান শরিফুল হাসান।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মূনীর শুক্রবার বেনারকে বলেন, “বাংলাদেশ থেকে যাঁরা অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলোতে যান, তাঁরা মনে করেন একবার সেখানে যেতে পারলে আর আসতে হবে না। জীবন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে।”

“এর অন্যতম কারণ হলো ইউরোপীয় দেশগুলোতে যত সংখ্যক মানুষ অবৈধভাবে যায়, তাদের মধ্যে খুব অল্প মানুষকে ফিরে আসতে হয়। সেই কারণে মানুষ সেখানে যেতে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ করে। এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সেখানে যেতে আগ্রহী হয়,” বলেন আসিফ।

তবে তাঁর মতে, “ইউরোপীয় ইউনিয়ন আইন কঠোর করলেও বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে মানুষ যাওয়া কমবে বলে মনে হয় না।”

বিষয়টির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হয়েছে কিন্তু আমাদের মানসিকতার তেমন পরিবর্তন হয়নি। যাঁরা অবৈধভাবে ইউরোপে যেতে চান তাঁরা আইনের ফাঁক-ফোকর বের করবেন; মানব পাচারকারীদের সহায়তায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের যেসব দেশে আইন কিছুটা সহজ সেখানে যাবেন।”

আইন কঠোর হলে ঝুঁকি বাড়বে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “আইন কঠোর হলে মানব পাচারকারীরা আরও বেশি পরিমাণ অর্থ নেওয়ার সুযোগ পাবে। এর সঙ্গে ইউরোপ যাওয়ার ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে; আরও বেশি সংখ্যক মানুষ যাত্রাপথে প্রাণ হারাবেন।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার বন্ধ করতে হলে লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চলমান যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। মানব পাচার বাংলাদেশের একার পক্ষে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটি বন্ধ করতে হলে, যেসব পথ দিয়ে ইউরোপে নেওয়া হয়, সেই দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।