‘বন্দুকযুদ্ধে’ বয়স্ক নাগরিক হত্যা: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মানবাধিকার কমিশনের আপত্তি

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.03.23
ঢাকা
‘বন্দুকযুদ্ধে’ বয়স্ক নাগরিক হত্যা: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মানবাধিকার কমিশনের আপত্তি নারায়ণগঞ্জে র‍্যাবের গুলিতে নিহত ৬৫ বছর বয়সী আবুল কাশেমের স্ত্রী ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রমিজা বেগমকে ধরে রেখেছেন তাঁর স্বজন ও প্রতিবেশীরা। ১৮ মার্চ ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায় র‍্যাবের সাথে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৬৫ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

বৃহস্পতিবার বিকালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে কমিশনের একটি প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে গেলে মন্ত্রী এই প্রতিশ্রুতি দেন।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‍্যাব ও এর সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এরপর এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা কমে আসে। র‍্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যা নাটকীয়ভাবে কমেছে- এমন মন্তব্য সংবলিত মার্কিন সরকারের মানবাধিকার প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশের পরই এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, গত কয়েক বছর মানবাধিকার রক্ষায় তেমন কোনো ভূমিকাই রাখেনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।

তবে তাঁদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন কমিশন মানবাধিকার রক্ষায় তৎপর হয়েছে যা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যদের তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটাতে কিছুটা হলেও সংযত করবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাস

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আজকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক হয়েছে। কীভাবে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন করা যায় সেবিষয়ে কথা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “বৈঠকে আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা কোনোভাবেই যেন মানুষের ওপর গুলি না চালায়। এগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন। এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

কমিশন চেয়ারম্যান বলেন, “মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ হিসাবে আমি সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে ‘ক্রসফায়ারে’ ঘটনায় একজন ষাটোর্ধ ব্যক্তির মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছি। মানুষ ডাকাত ডাকাত বলে চিৎকার করল আর তারা গুলি করে দিলো। ওই গুলিতেই একজন নিরীহ ষাটোর্ধ ব্যক্তি নিহত হলেন। এগুলো কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।”

তিনি বলেন, “আমাদের অবস্থান হলো, এই ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।”

কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমি মন্ত্রীকে বলেছি, দেশে মানবাধিকার কমিশন যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে তাহলে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।”

মন্ত্রীর সাথে এই বৈঠকের দুদিন আগে গত মঙ্গলবার বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্স, জার্মানী, সুইডেন ও নেদারল্যান্ডস এর রাষ্ট্রদূতরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের সাথে বৈঠক করে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

“স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন এবং এই ঘটনা সুষ্ঠু তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন,” বলেন কামাল উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, “মানবাধিকার রক্ষায় নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্রভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে কাজ করতে উৎসাহিত করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। উনি আমাদের বলেছেন, আমরা যেন মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখি।”

মানবাধিকার কমিশনের দুই সদস্য সেলিম রেজা ও বিশ্বজিৎ চন্দ এবং কমিশনের অন্যান্য কর্মকর্তারা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

কীভাবে মারা যান আবুল কাশেম

১৮ মার্চ শনিবার প্রথম প্রহরে (রাত সাড়ে ১২টার দিকে) নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের বরগাঁ এলাকায় র‍্যাবের সাথে “বন্দুকযুদ্ধে” ৬৫ বছর বয়স্ক আবুল কাশেম নামের এক ব্যক্তি নিহত হন।

র‍্যাব ঘটনাটিকে “বন্দুকযুদ্ধ” বলে দাবি করলেও পরিবারের সদস্যরা বলছেন ভিন্ন কথা।

১৭ মার্চ শুক্রবার দিবাগত রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে র‌্যাব-১১ এর একটি দল আসামি আটক করতে ঘটনাস্থলে যায়।

র‍্যাব বলছে, আসামি গ্রেপ্তারের পর ফেরার পথে “কিছু দুষ্কৃতকারী আসামিকে ছিনিয়ে নিতে র‌্যাবের ওপর আক্রমণ করলে র‌্যাব সদস্যরা আহত হন। র‌্যাব সদস্যরাও “আত্মরক্ষার্থে” পাল্টা গুলি করলে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং ওই ঘটনায় আবুল কাশেম নিহত হন।

তবে নিহতের পরিবার বলছেন ভিন্ন কথা।

পেশায় একজন বাঁশ ও বেতের কারিগর আবুল কাশেমের স্ত্রী রমিজা বেগম সাংবাদিকদের জানান, শনিবার রাতে তাঁদের বাড়ির আশেপাশে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পান। বাসা থেকে বেরিয়ে দেখতে পান তাঁদের পরিচিত তৈরি পোশাক শ্রমিক সেলিমকে কিছু মানুষ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আটক সেলিম কাঁদতে কাঁদতে সাহায্য চাইছিলেন।

ওই শার্ট ও গেঞ্জি পরা ব্যক্তিরা কারা সেব্যাপারে তাঁরা কেউই জানতেন না। আশেপাশের সবাই ভেবেছিলেন গ্রামে ডাকাত পড়েছে অথবা অপহরণকারীরা সেলিমকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

রমিজা বলেন, এমতাবস্থায় সেলিমকে আটককারী ব্যক্তিদের কাছে জানতে চান কেন তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

সাদা পোশাকের ওই ব্যক্তিরা লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকলে তাদের গালাগাল করেন কাশেম। ওই ব্যক্তিদের একজন নিজেদের র‌্যাব পরিচয় দিয়ে পেটে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে বলে জানান রমিজা।

তৎপর কমিশন

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে মানবাধিকার রক্ষায় অথবা সংরক্ষণে তেমন কোনো চেষ্টাই করেনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর ছিল বলা যায়।

তিনি বলেন, তবে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন কমিশন গঠিত হওয়ার পর সংস্থাটির কিছুটা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে।

অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যখন মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করে মানবাধিকার লঙ্ঘন অথবা বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি উত্থাপন করে তখন সেটির অবশ্যই গুরুত্বে থাকে, মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ওপর চাপ সৃষ্টি হয়।

তিনি বলেন, “তবে, মন্ত্রী যদি বিষয়টি সিরিয়াসলি নেন সেক্ষেত্রে অবশ্যই মাঠ পর্যায়ে এর প্রভাব পড়বে। আমি আশা রাখি সরকার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কথা গুরুত্বের সাথে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেবেন।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।