র্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু: উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি করতে হাইকোর্টের আদেশ
2023.04.05
ঢাকা ও ওয়াশিংটন
নওগাঁয় র্যাবের হেফাজতে চণ্ডিপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভূমি অফিসের নারী কর্মচারী সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের সমন্বয়ে “উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি” গঠন করতে সরকারকে আদেশ দিয়েছে উচ্চ আদালত।
এ বিষয়ে দায়ের করা একটি রিটের শুনানি শেষে বুধবার মন্ত্রীপরিষদ সচিবকে এই আদেশ দেন বিচারক ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।
রিটকারী আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক এবং সরকারের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ.এম. আমিন উদ্দিন পৃথকভাবে এই আদেশের বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেন।
এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য সুলতানা জেসমিনের পরিবার কোনো মামলা দায়ের করেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে র্যাবের হেফাজতে অথবা “ক্রসফায়ারে” মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে আদালত থেকে এ ধরনের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠনের আদেশ এটিই প্রথম। কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে সময় দেয়া হয়েছে ৬০ দিন।
আদালতের এই আদেশ ও সরকারের প্রতি রুল জারির বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসাবে বিবেচনা করে স্বাগত জানিয়েছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ।
মনোজ কুমার বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, আদালত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটির প্রধান অথবা সদস্য সংখ্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু না বললেও কমিটিতে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং জেলা জজ পর্যায়ের কর্মকর্তাকে অন্তর্ভুক্ত করতে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও তাঁর মনোনীত সদস্য কমিটিতে রাখতে পারবেন।
মনোজ কুমার বলেন, এই তদন্ত চলাকালে সুলতানা জেসমিনকে আটক এবং জিজ্ঞাসাবাদকারী র্যাব কর্মকর্তাদের সেখানকার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, “এ ছাড়াও বিনা গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় সুলতানা জেসমিনকে আটক করাসহ পুরো ঘটনা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়ে সরকারের প্রতি রুলও জারি করেছেন আদালত।”
সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া আটক করা যাবে না।
শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের নেতৃত্ব দেওয়া অ্যাটর্নি জেনারেল এ. এম. আমিন উদ্দিন রুল জারি করার বিরোধিতা করেন।
আদালতের এই রুল জারির বিপক্ষে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে কোনো আবেদন করবেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, “আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।”
‘এই মৃত্যুর জন্য দায়ী কারা?’
গত ২২ মার্চ সকাল ১০টার দিকে অফিসে যাওয়ার পথে সুলতানা জেসমিনকে নওগাঁ শহরের নওজোয়ান মাঠের কাছ থেকে আটক করে র্যাবের একটি দল।
আটকের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাঁকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে এবং অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাঁকে পরবর্তীতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
সেখানেই শুক্রবার মারা যান সুলতানা জেসমিন।
তবে বিষয়টি গণমাধ্যমে আসে দুই দিন পর রোববার।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুলতানা জেসমিনের কপালের এক পাশে এবং কনুইয়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
র্যাব জানিয়েছে, আটকের পর র্যাব সদস্যরা তাঁর মোবাইল ফোন চাইলেই তিনি অচেতন হয়ে পড়েন এবং তাঁকে প্রথমে নওগাঁ সদর হাসপাতাল এবং পরে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
র্যাব বলছে, তাঁকে কোনো প্রকার নির্যাতন করা হয়নি।
গত ২৭ মার্চ প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক। প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে এই ঘটনা সম্পর্কে পুরো তথ্য চেয়ে পাঠায় আদালত।
আদালতে দাখিল করা প্রতিবেদন অনুযায়ী অস্বাভাবিক ও উচ্চ রক্তচাপজনিত কারণে মারা গেছেন সুলতানা জেসমিন। তবে পরিবারের সদস্যরা বলছেন, অন্য কথা।
সুলতানা জেসমিনের মামা নাজমুল হক মন্টু বুধবার বেনারকে বলেন “আমার ভাগ্নি ভালো মানুষ। তারপরও যদি সে খারাপ কিছু করত সেটির বিচার প্রক্রিয়া আলাদা। কিন্তু সেটি না করে অফিসে যাওয়ার পথে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া তো সঠিক কাজ হয়নি।”
তিনি বলেন, “তার মাথায় ও হাতে আঘাত ছিল বলে জানা গেছে। আমার ভাগ্নি র্যাবের হাতে আটকের এই অপমান নিতে পারেনি। সেকারণে মানসিক চাপে সে মারা গেলেও এই মৃত্যুর জন্য দায়ী কারা?”
মন্টু বলেন, “আমরা মামলা করিনি। তবে আজকে আদালত থেকে যে আদেশ এসেছে সেটির ওপর আমরা আস্থা রাখতে চাই। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত বলে আমি মনে করি।”
তিনি বলেন, “তবে আমার কথা, এই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে যে ৬০ দিন সময় দেয়া হয়েছে এর মধ্যে যেন তদন্তে ভাটা না পড়ে।”
“র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হলো আমার ভাগ্নির হিসাবে ৭০ লাখ ৮০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। কিন্তু আমরা হিসাবের স্টেটমেন্ট তুলে দেখেছি সেখানে লেনদেন হয়েছে মাত্র ১৯ লাখ টাকা, যার মধ্যে তার বেতনও রয়েছে,” জানান মন্টু।
আদালতের এই আদেশ সম্পর্কে মতামত জানতে প্রশ্ন করা হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ বুধবার বেনারকে বলেন, “আদালত থেকে আজ যে আদেশ এসেছে, সেটি আমি মনে করি সঠিকভাবেই হয়েছে।”
তিনি বলেন, “আদালত তাদের দিক থেকে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে এবং আমরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন থেকে আমাদের মতো কাজ করছি।”
র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর পর বিষয়টি তদন্ত করে বিস্তারিত জানতে স্বরাষ্ট্র সচিবকে চিঠি দেয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কমিশনকে কিছু জানানো হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “মন্ত্রণালয় এখনও এ ব্যাপারে আমাদের কিছু জানায়নি। বিষয়টি তদন্তের পর্যায়ে রয়েছে। আশা করি তারা জানাবে।”
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন ‘হাসির খোরাক’: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
উল্লেখ্য, মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের বিশেষ পুলিশ র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
জার্মানিভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়চে ভেলের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র্যাবকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ সপ্তাহে ডয়চে ভেলে এবং নেত্র নিউজ র্যাব বিষয়ে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তার শিরোনাম ‘ডেথ স্কোয়াড’: ব়্যাবের ভেতরের কথা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অভিজাত সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনী বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাই এসব হত্যার অনুমতি দেন।
যদিও র্যাব নিয়ে ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন হাসির খোরাক বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।
গত ৩ এপ্রিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গোয়েন লুইসের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করেন তিনি। র্যাবকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা বিষয়ে জানতে চাইলে মোমেন বলেন, “এটি হাসির খোরাক আরকি। তারা (র্যাব) রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে না। নিরাপত্তার উদ্দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে র্যাব।”