র‌্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু: সরব উচ্চ আদালত ও মানবাধিকার সংগঠন

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.03.27
ঢাকা
র‌্যাব হেফাজতে নারীর মৃত্যু: সরব উচ্চ আদালত ও মানবাধিকার সংগঠন ঢাকার একটি রাস্তায় যানবাহন তল্লাশির সময় দায়িত্ব পালন করছেন একজন র‍্যাব সদস্য। ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮।
[এপি]

নওগাঁয় র‌্যাবের হেফাজতে এক নারীর মৃত্যুর তিনদিন পর অস্বাভাবিক ওই ঘটনা নিয়ে সরব হয়েছে দেশের উচ্চ আদালত, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠন।

নওগাঁর চণ্ডিপুর ভূমি অফিসের কর্মচারী সুলতানা জেসমিনকে (৪২) কেন আটক করা হয়েছিল, কে আটক করেছিল সে সম্পর্কে সোমবার বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়েছে উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চ।

আদালত সূত্র জানিয়েছে, আগামীকাল মঙ্গলবার এই বিষয়ে শুনানি হতে পারে।

র‌্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনাটি তদন্ত করে দ্রুততম সময়ে প্রতিবেদন পাঠাতে স্বরাষ্ট্র সচিবকে অনুরোধ করেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বেনারকে এই তথ্য জানিয়েছেন।

জেসমিন সুলতানার মৃত্যু ঘটনায় সোমবার বিবৃতেতে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ), ২০১৩ এর আওতায় তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং হিউম্যান রাইটস ফোরাম।

প্রতিবেদন জমা দেবার নির্দেশ

আইনজীবী মনোজ কুমার ভৌমিক নওগাঁয় র‌্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর সংবাদটি বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের বেঞ্চের নজরে আনেন।

প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে আদালত ঘটনা সম্পর্কে জানতে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল কালাম খানকে সুরতহাল প্রতিবেদন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং ওই নারীকে কেন আটক করা হয়েছিল, কে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তা আগামীকাল মঙ্গলবারের মধ্যে জানাতে নির্দেশ দিয়েছে।

শুনানি শেষে মনোজ কুমার ভৌমিক ও আবুল কালাম গণমাধ্যমকর্মীদের এই তথ্য জানিয়েছেন।

প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, গত ২২ মার্চ সকাল ১০টার দিকে অফিসে যাওয়ার পথে সুলতানা জেসমিনকে নওগাঁ শহরের নওজোয়ান মাঠের কাছ থেকে আটক করে র‌্যাবের একটি দল। আটকের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাঁকে নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাঁকে পরবর্তীতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেই বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে সুলতানা জেসমিন মারা যান।

রোববার একটি গণমাধ্যমে এই বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

জেসমিনের মামা ও নওগাঁ পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর নাজমুল হক মন্টু সোমবার বেনারকে বলেন, “আটকের পরে তাঁর ভাগ্নির কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। হঠাৎ জানতে পারি যে, জেসমিন অসুস্থ, নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি। জেসমিন কথা বলতে পারছিল না। পরে জানতে পারি যে, জেসমিন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছে।”

মন্টু বলেন, “আমার ভাগ্নির বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রকার অভিযোগ দিতে পারবে না। তার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার মামলা নেই কিন্তু কেন তাঁকে আটক করা হলো, তাঁকে এভাবে মরতে হলো তা আমার বোধগম্য নয়।”

“তবে আমরা মামলা করার কথা চিন্তা করছি না। মামলা করা তো ঝামেলার,” বলেন তিনি।

জেসমিনের ছেলে শাহেদ হোসেন সৈকত সাংবাদিকদের বলেন, র‌্যাবের হাতে নির্যাতনে ফলেই তার মা মৃত্যুবরণ করেছেন।

স্বরাষ্ট্র সচিবকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চিঠি

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বেনারকে বলেন, “নওগাঁয় র‌্যাবের হেফাজতে মৃত্যুবরণকারী নারী সুলতানা জেসমিন কীভাবে মারা গেলেন, তাঁকে কেন আটক করা হয়েছিল তা জানতে আমি আজকে স্বরাষ্ট্র সচিবকে চিঠি দিয়েছি। আমরা বলেছি, পুরো ঘটনা তদন্ত করে যেন বিষয়টি সম্পর্কে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে জানানো হয়।”

তিনি আরও বলেন, “আমি সংবাদমাধ্যমে জানতে পারলাম, হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার সাংবাদিকদের বলেছেন যে, সুলতানা জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা গেছেন। আমি চিঠিতে লিখেছি, ডাক্তার কীভাবে জানলো যে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তিনি পড়ে গিয়েছিলেন? জিজ্ঞাসাবাদের সময় ডাক্তার কি উপস্থিত ছিলেন? এসব কথা কেন বলা হচ্ছে? এগুলো গ্রহণযোগ্য কথা নয়।”

কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা এই মৃত্যুর জন্য দায়ীদের শাস্তির পক্ষে।”

যা বলছে র‌্যাব

র‌্যাবের গণমাধ্যম ও আইন বিষয়ক পরিচালক আল মঈন সোমবার বেনারকে বলেন, “নওগাঁয় যে নারীর মৃত্যু হয়েছে, সে বিষয়ে উচ্চ আদালত থেকে আমাদের কাছ থেকে কিছু কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। আমরা আগামীকালের মধ্যে সেগুলো সরবরাহ করব।”

তিনি বলেন, “জাতীয় মানবাধিকার কমিশন যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছে সেটি নিয়ে আমাদের অবস্থান হলো, সেটি উনাদের কাজ, উনারা করছেন।”

উত্থাপিত অভিযোগ অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করা হবে জানিয়ে মঈন বলেন, “যদি কেউ দায়ী হয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কীভাবে মারা গেলেন সুলতানা জেসমিন-জানতে চাইলে মঈন বলেন, “উনার বিরুদ্ধে একজন যুগ্ম সচিবের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে অর্থ আদায়ের অভিযোগ আছে। র‌্যাব সদস্যরা যখন তাঁর মোবাইল ফোন দেখতে চেয়েছেন, তখনই তিনি অজ্ঞান হয়ে যান।”

“চিকিৎসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী উনি স্ট্রোকে মারা গেছেন,” জানান মঈন।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ক্ষোভ

সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ব্যাপারে সোমবার পৃথক বিবৃতি দিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বিবৃতিতে বলা হয়, প্রতারণার অভিযোগে গত ২২ মার্চ সকালে সুলতানা জেসমিনকে আটক করে র‌্যাব। ২৩ মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করা হয়। তবে র‌্যাবের পক্ষ থেকে এই আটকের ব্যাপারে পুলিশকে কিছু জানানো হয়নি।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, পরিবারের অভিযোগ, র‌্যাবের নির্যাতনের ফলে মৃত্যু হয়েছে সুলতানা জেসমিনের। বলা হয়, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক জানিয়েছেন, ভর্তির সময় জেসমিনের মাথার ডান পাশে আঘাত ছিল এবং মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে বলে সিটি স্ক্যান প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, অভিযোগগুলো যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়।

হিউম্যান রাইটস ফোরাম বাংলাদেশ বিবৃতিতে জানিয়েছে, জেসমিন সুলতানার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে মামলা করা হয়েছে, সেটি দায়ের করা হয়েছে তাঁকে আটকের ৩১ ঘণ্টা পরে। অর্থাৎ ২৩ মার্চ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে।

এর আগে গত ১৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলায় ৬৫ বছর বয়স্ক আবুল কাশেম বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন। পরিবার অভিযোগ করে, র‌্যাবের গুলিতে তিনি নিহত হয়েছেন।

যদিও র‌্যাব বলেছে, আসামি ধরার সময় গোলাগুলিতে ওই ব্যক্তি কার গুলিতে নিহত হয়েছেন তা স্পষ্ট নয়।  ঘটনা তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র‌্যাব ও এর সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন সরকার অবরোধ আরোপ করে। এরপর র‌্যাবের হাতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে আসলেও গত এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো আবার সোচ্চার হয়ে উঠেছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।