তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতার নেপথ্যে বহিরাগতরা, ১৩০ কারখানা বন্ধ
2024.09.03
ঢাকা
চাকরিতে পুনর্বহাল ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের টানা তৃতীয় দিনের মতো আন্দোলনে মঙ্গলবার সাভার ও গাজীপুর এলাকায় কমপক্ষে ১৩০টি কারখানা উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই খাতটিতে অস্থিরতার ঘটনা এটিই প্রথম।
তবে মালিক ও শ্রমিক নেতারা বলছেন, কারখানার শ্রমিক নয় বরং বহিরাগতরা শিল্প এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে।
অস্থিরতার মধ্যে সোমবার গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ জেলার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এলাকায় অন্তত ১৫০টি পোশাক কারখানার উৎপাদন বন্ধ করা হয়।
সোমবারের অস্থিরতার পর কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করে এবং অস্থিরতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে শিল্প এলাকায় সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের যৌথ অভিযান শুরু করে।
“মঙ্গলবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সমস্ত কারখানা স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরে আসে। বিকেলের দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সরে গেলে গেলে হঠাৎ একদল লোক আবার রাস্তায় নেমে ভাঙচুর শুরু করে,” বেনারকে বলেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন।
তিনি বলেন, এই ঘটনার পর মঙ্গলবার প্রায় ১৩০টি কারখানা আবারও উৎপাদন স্থগিত করেছে।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বহিরাগতরা চাকরির দাবিতে কারখানার সামনে জড়ো হয়েছিল এবং তারা কারখানার শ্রমিকদের কাজ ছেড়ে তাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল।
“কিছু লোক এই ধরনের অস্থিরতা তৈরি করে অবৈধ সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি এবং তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে,” যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি সারোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “আমরা শ্রমিকরা শিল্প উৎপাদন ধরে রাখতে চাই আমাদের শ্রমিকদের কিছু দাবি পরিকল্পিতভাবে আদায় করতে চাই, কিন্তু এখন যারা পোশাক কারখানায় হামলা করেছে তারা শ্রমিক নয়।”
তিনি বলেন, এই খাতকে অস্থিতিশীল করতে একদল বহিরাগত এই হামলা চালিয়েছে
“আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি দেইনি... কিছু পোশাক কারখানার অভ্যন্তরীণ কর্মসূচি ছিল। হামলাকারীরা সেই সুযোগ নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে,” বলেন তিনি।
দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ‘ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেওয়াসহ নানা ধরনের সুবিধার জন্য তৎপর রয়েছে বলে সন্দেহ করেন তিনি।
কারখানায় বাতিল পোশাকের ব্যবসাকে স্থানীয়ভাবে ‘ঝুট ব্যবসা’বলা হয়। রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী ঐতিহ্যগতভাবে এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে কারণ বাংলাদেশের স্থানীয় বাজারে রপ্তানি মানের বাতিল পোশাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
এদিকে, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, কিছু বহিরাগত, যাদের শিল্প বা এর শ্রমিকদের সাথে সরাসরি কোন সংযোগ নেই, তারা কারখানায় আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করছে এবং বিক্ষোভে অংশ নিতে শ্রমিকদের উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে।”
ঢাকায় তার মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর উপদেষ্টা মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, মজুরি ও ভাতা নিয়ে শ্রমিকদের কিছু বিক্ষোভ ন্যায্য এবং সেগুলো মানার জন্য সরকার আন্তরিক।
সরকার শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দবি করে তিনি বলেন, “তবে শিল্পের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য বহিরাগতদের প্রচেষ্টা বরদাশত করা হবে না।
“ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের কারণে অস্থিরতা আরও বেড়েছে এবং রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা এই কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে,” বলেন তিনি।
পরিস্থিতি দুই-একদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হবে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “ষড়যন্ত্রকারীদের ধরতে যৌথবাহিনীর অভিযান অব্যাহত আছে, তাদের কোন্ও ছাড় দেয়া হবে না।”
তিনি বলেন, গত ফ্যাসিবাদী সরকার একপেশে আচরণ করেছে এবং গত বছর মজুরি নির্ধারণ আন্দোলনে গুলি করে ৪ জন শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে।
“নিপীড়নমূলক মামলা দেয়া হয়েছে শ্রমিকদের নামে। এই সরকার শ্রমিকদের ন্যায্য এবং আইনসংগত সকল দাবি পূরণে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে কাজ করতে বদ্ধপরিকর,” বলেন তিনি।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান হোসেন সাংবাদিকদের জানান, বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভের একপর্যায়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে যানবাহন চলাচলে বাধা দেওয়া হয়।
“খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হন। পরে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে শ্রমিকদের রাস্তা থেকে সরিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে,” বলেন তিনি।
গাজীপুরের কোনাবাড়ি এলাকার যমুনা ডেনিমের শ্রমিক খোকন মিয়া বেনারকে বলেন, “আমরা কয়েকদিন আগে বকেয়া মজুরি ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছি। এখন কারা আমাদের ফ্যাক্টরি এলাকায় এসে আন্দোলন করছে, তা আমরা জানি না।”
এদিকে, মঙ্গলবার সকালে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৈঠক শেষে ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে বলে আশ্বস্ত করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।