পাকিস্তানে তৈরি জাল রুপি বাংলাদেশ হয়ে ভারতে যাচ্ছে

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.02.09
ঢাকা
পাকিস্তানে তৈরি জাল রুপি বাংলাদেশ হয়ে ভারতে যাচ্ছে ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে ১৫ লাখ ভারতীয় রুপিসহ ধরা পড়া পাচারকারী চক্রের ৪সদস্য। ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২।
[সাবরিনা ইয়াসমীন/বেনারনিউজ]

পাকিস্তানের বন্দরনগরী করাচি ভিত্তিক সিন্ডিকেটের সহায়তায় ভারতীয় ‘সুপার’ জাল রুপি পাচারের অভিযোগে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালক ও তাঁর আইনজীবী স্ত্রীসহ মোট চারজনকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ.কে.এম হাফিজ আক্তার জানান, “সোমবার ও মঙ্গলবার পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড এলাকা এবং হাজারীবাগে পৃথক অভিযানে এই চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে মোট ১৫ লাখ ‘সুপার‘ জাল ভারতীয় রুপি উদ্ধার করা হয়েছে।

আটক ব্যক্তিরা হলেন; সুনামগঞ্জ জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গাড়িচালক আমানুল্লাহ ভূঁইয়া (৫২), তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ও আইনজীবী কাজল রেখা (৩৭), ইয়াসিন আরাফাত কেরামত (৩৩) এবং নোমানুর রহমান (৩১)।

গত বছর নভেম্বরে পুলিশ সাত কোটি ৩৫ লাখ ভারতীয় সুপার জাল নোট উদ্ধার এবং দুই ব্যক্তিকে আটক করে। ওই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে এই চারজনের সন্ধান পায় পুলিশ।

‘সুপার জাল’ নোটের বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাফিজ আক্তার বেনারকে বলেন, এসব জাল নোট এমনভাবে তৈরি করা যে, কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই এগুলো জাল। সাধারণত জাল নোটে একই সিরিয়াল বিভিন্ন নোটে দেখা যায় এবং নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকে না।

কিন্তু উদ্ধার হওয়া প্রতিটি নোটে ভিন্ন ভিন্ন সিরিয়াল নম্বর রয়েছে এবং সকল নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান বলে জানান তিনি।

কীভাবে আসে এই জাল নোট?

হাফিজ আক্তার জানান, গ্রেপ্তারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান থেকে আন্তর্জাতিক চক্রের মাধ্যমে ভারতীয় জাল রুপির সুপার পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট বিভিন্ন কৌশলে সংগ্রহ করে বিভিন্ন পণ্যের ভিতর, ব্যক্তি বা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকা দিয়ে ভারতে পাচার করে আসছিল।

হাফিজ আক্তার জানান, এই জাল রুপি পাচারকারী চক্রের কেন্দ্রে আছে মূলত দুটি পরিবার। একটি মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার ও অপরটি সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়।

তিনি জানান, মুন্সিগঞ্জের পরিবারটির অধিকাংশ সদস্য একসময় পাকিস্তানে বসবাস করতেন। বর্তমানে এই পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্য ফজলুর রহমান পাকিস্তানের করাচিতে রয়েছেন। পাকিস্তানকেন্দ্রিক মাফিয়াদের কাছ থেকে উন্নতমানের জাল রুপি সংগ্রহ করে সেগুলো কখনো শুঁটকি মাছ, কখনো মোজাইক পাথর, কখনো বা অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রীর বস্তার মধ্যে করে সমুদ্রপথে বাংলাদেশ পাঠাতেন ফজলুর।

এ কাজে তাঁর সহযোগী ছিলেন ফজলুরের ভাই সাইদুর রহমান, নোমানুর রহমান এবং ভগ্নীপতি শফিকুর রহমান। আমদানিকারকদের সাথে মিলে পাকিস্তানের করাচি বন্দর থেকে শ্রীলঙ্কা হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনারের মাধ্যমে আনা হতো জাল রুপি। করাচি থেকে আকাশপথেও বাংলাদেশে আসত এই জাল নোট।

পরবর্তীতে তা খালাস করে গোডাউনে মজুদ করে বা বিভিন্ন মাধ্যমে সেগুলো ডিলারদের পরিবেশন করা হতো। পরিবেশনের দায়িত্বে ছিল মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার বেনীচক গ্রামের কাজল রেখার পরিবার।

এই পরিবারের সদস্য আটক আমানুল্লাহ ও কাজল রেখাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কখনো লাগেজে, কখনো কুরিয়ারের মাধ্যমে এবং কখনো শরীরে বহন করে এই জাল মুদ্রা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে ভারতে পাচার করতেন।

অপারেশন পরিচালনাকারী ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বুধবার বেনারকে বলেন, এই ধরনের একলাখ রুপি পাচার করতে পারলে চক্রের সদস্যরা ৩৮ হাজার টাকা পেতো।

এই টাকার একটি বড়ো অংশ হুন্ডির মাধ্যমে পাকিস্তানে পাঠানো হতো বলে তিনি জানান।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার ফারুক হোসেন বেনারকে বলেন, আটক চারজনকে বুধবার আদালতে সোপর্দ করা হলে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচদিনের রিমান্ড মঞ্জ‍ুর করেছে আদালত।

অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার হাফিজ আক্তার বেনারকে বলেন, “আমরা সুপার জাল নোট উদ্ধারের বিষয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তাঁদের কর্মকর্তারা চাইলে আটক আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবে।”

এই বিষয়ে ঢাকাস্থ পাকিস্তান দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

জাল রুপির ব্যবহার কমেছে

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ.কে.এম. শহীদুল হক বুধবার বেনারকে বলেন, ২০১২ সালের পর থেকে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতে জাল মুদ্রা পাচার করে আসছে পাকিস্তান ভিত্তিক একটি গ্রুপ।

তিনি বলেন, “তারা এত উন্নতমানের ভারতীয় রুপি তৈরি করে, কোনোভাবেই বোঝাই যাবে না এগুলো জাল। আমরা উদ্ধার করা জাল রুপিগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি।”

শহীদুল হক বলেন, “সাধারণত কোরবানি ঈদের সময়ে যখন ভারত থেকে প্রচুর সংখ্যক গরু বাংলাদেশে আসত, তখন সীমান্ত এলাকা দিয়ে সিন্ডিকেটের সদস্যরা জাল নোট ভারতে পাঠাত।”

তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক এই সিন্ডিকেট ভাঙতে বাংলাদেশের সিআইডি (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) এবং ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সি এর সমন্বয়ে একটি যৌথ টাস্কফোর্স আছে। এই টাস্কফোর্সের কারণে জাল রুপির ব্যবহার কমেছে।”

শহীদুল হক বলেন, “এখন ভারত থেকে খুব বেশি সংখ্যক গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করে না । তাই জাল রুপির ব্যবহার আগের চেয়ে কমে আসলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।