ফুটবল বিশ্বকাপ: শ্রম, ঘাম ও উৎসবের আনন্দে সক্রিয় বাংলাদেশ
2022.11.18
ঢাকা
বিশ্বকাপে ফুটবল খেলতে না পারলেও পুরো উৎসব ও আয়োজনে সক্রিয় অংশ রয়েছে বাংলাদেশের।
আগামী রোববার থেকে কাতারে শুরু হতে যাওয়া ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপের চোখ ধাঁধানো স্টেডিয়ামসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা তৈরি করতে গিয়ে এক দিকে যেমন শ্রম দিয়েছেন অসংখ্য প্রবাসী বাংলাদেশি, প্রাণও দিয়েছেন অনেকে।
অন্যদিকে ফুটবলের সবচে বড়ো আসর বিশ্বকাপকে ঘিরে উৎসবে মেতে উঠেছে বাংলাদেশ, ফিফার জার্সি বানাতেও রাতদিন খেটেছেন গার্মেন্টস শ্রমিকেরা।
আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা ‘ফিফা’র বর্তমান র্যাংক তালিকায় মোট ২১১টি দলের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অবস্থান ১৯২তম।
বাংলাদেশ দল এখন পর্যন্ত কোনো ফিফা বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেনি। শুধু ১৯৮০ সালে ফিফার আঞ্চলিক সংস্থা এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের এশিয়া কাপের বাছাই পর্বে যেতে পেরেছিল।
বিশ্ব ফুটবলে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হলেও প্রতিটা বিশ্বকাপে উৎসবে মেতে ওঠে বাংলাদেশ। বাংলাদেশি ফুটবল ভক্তরা মূলত ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা দলের সমর্থক। এর বাইরেও কিছু সমর্থক রয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন বড়ো দলের।
ফিফার বর্তমান র্যাংকিং-এ সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে ব্রাজিল, আর আর্জেন্টিনার অবস্থান তৃতীয়।
বাংলাদেশের বিশ্বকাপ উৎসব
ফুটবল বিশ্বকাপকে ঘিরে বাংলাদেশের লাখো ফুটবলপ্রেমী ইতিমধ্যেই তাঁদের পছন্দের দলের পতাকা দিয়ে বাড়িঘর ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাজিয়েছেন। রাস্তার পাশের উন্মুক্ত দেয়ালে আঁকা হয়েছে প্রিয় খেলোয়াড়দের ছবি। ভিন্ন দলের সমর্থকদের সাথে পাড়াতে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তিতর্কেও মেতেছেন বিভিন্ন দলের ভক্তরা।
পছন্দের দলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিভিন্ন স্থানে মিছিল ছাড়াও মোটরবাইক শোভাযাত্রা হচ্ছে। রাঙ্গামাটিতে ভক্তরা ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পতাকার রঙে রাঙিয়েছেন দুটি দীর্ঘ সেতু।
ফুটবল উত্তেজনা কখনো কখনো বাংলাদেশি সমর্থকদের হিংসাত্মকও করে তোলে। ২০১৮ সালে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ছুরকিাঘাতে একজন ভক্তের মৃত্যু হয়েছিল।
গত বুধবার টাঙ্গাইলে পতাকা টাঙাতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক স্কুল পড়ুয়া আর্জেন্টাইন সমর্থকের মৃত্যু হয়েছে।
এসবের পরও পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে আনন্দ নিয়ে খেলা উপভোগে উন্মত্ত থাকেন দেশের ফুটবল ভক্তরা, যদিও একই পরিবারেই পাওয়া যায় ভিন্ন ভিন্ন দলের সমর্থক।
“আমি নিজের জন্য কিনেছি আর্জেন্টিনার জার্সি। দুর্ভাগ্যবশত, আমার ছোট ভাই ব্রাজিলকে সমর্থন করে, তাই আমি তাকে একটি ব্রাজিলিয়ান জার্সি উপহার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি,” বেনারকে বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরমান হোসেন।
ঢাকার গুলিস্তানের স্পোর্টস ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপক নাসিমুল হক বেনারকে জানান, গত তিন সপ্তাহে তাঁর দোকানে শতাধিক জার্সি বিক্রি হয়েছে। যার মধ্যে সর্বোচ্চে রয়েছে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের জার্সি।
“আমাদের বেশিরভাগ গ্রাহকই তরুণ। তারা খেলোয়াড়দের জার্সি এবং তাদের প্রিয় দলের প্লেয়ার ও ফ্যান উভয় সংস্করণ সংগ্রহ করছে,” বলেন নাসিম।
শহর এলাকার দোকানগুলোতে একটি জার্সির দাম ৮৪০ থেকে ১২৬০ টাকা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। তবে রাস্তার পাশে ফুটপাতের দোকানগুলোতে জার্সি পাওয়া যাচ্ছে আরো সস্তায়।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ টেলিভিশনে বিশ্বকাপ দেখলেও অনেকেই স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখার জন্য যাচ্ছেন কাতার।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) এবং ফিফার অফিসিয়াল বিশ্বকাপ টিকেট বিক্রয় এজেন্ট ডিসকভারি ট্যুরস অ্যান্ড লজিস্টিকস-এর হিসাবে, এ বছর এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি ইতিমধ্যে কাতার ফুটবল বিশ্বকাপের টিকিট কিনেছেন।
“কাতারের গ্যালারি থেকে লাইভ ম্যাচ উপভোগ করতে প্রতি ভক্তকে প্রায় তিন লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে,” বলে বেনারকে জানান ডিসকভারি ট্যুরস অ্যান্ড লজিস্টিকসের প্রধান নির্বাহী জহিরুল আলম ভূঁইয়া।
পেছনে রয়েছে শ্রম ও ঘাম
ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ২০২২ আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়ার শুরু থেকেই নানা কারণে বিতর্কে জড়িয়েছে কাতার। তবে সেই বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছে নির্মাণ শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক আচরণের কারণে।
কাতারে বিশ্বকাপ অবকাঠামো নির্মাণের সাথে যুক্ত হাজার হাজার শ্রমিকদের একজন মুন্সীগঞ্জের মিরাজ হোসেন।
দশ মাস কাতারের রাজধানী দোহায় নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করা মিরাজ বেনারকে বলেন, “আমিসহ অনেক শ্রমিক পর্যাপ্ত খাবার পাইনি। আমি অনেক মারাত্মক দুর্ঘটনার সাক্ষী।”
“এত কিছুর পরও যখন দেখবে আমাদের অবদান থাকা স্টেডিয়ামে প্রিয় দলগুলো খেলছে, এটা আমাদের জন্য আনন্দের,” বলেন মিরাজ।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত লন্ডনভিত্তিক দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১১ সালে বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে দোহায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে যাওয়া প্রায় সাড়ে ছয় হাজার অভিবাসী শ্রমিক মারা গেছেন। উপর থেকে পড়ে এবং নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেলেও শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যু।
দ্য গার্ডিয়ানের অনুসন্ধানের বিষয়ে এখনো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
শ্রমিকদের প্রতি অন্যায্য আচরণের ঘটনা “যদি ঘটে থাকে তবে তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক,” মন্তব্য করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন বেনারকে বলেন, “তবে, আমি নিয়মিত কাতারে আসা-যাওয়া সত্ত্বেও কোনো বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক আমার সাথে এমন অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেননি।”
প্রসঙ্গত, কাতারে বিশ্বকাপের অবকাঠামো নির্মাণে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের প্রবাসী শ্রমিকদের অস্বাস্থ্যকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে- এমন অভিযোগ বিভিন্ন সময়েই বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
“আমরা আশা করি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কখনই কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের কথা ভুলে যাবে না,” বেনারকে বলেন অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়ারবে ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক।
এদিকে চট্টগ্রামের সনেট টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এ বছর ফিফার জন্য তৈরি করেছে প্রায় ৬ লাখ জার্সি। এসব জার্সি পরেই মাঠে থাকবেন ফিফা অফিসিয়ালরা যেখানে লেখা থাকবে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’।
দুই মাস ধরে কয়েকশ কর্মী তৈরি করেছেন এসব জার্সি।
“ফিফার জন্য এসব জার্সি তৈরি করা আমার ফুটবলপ্রেমী কর্মীদের এবং আমার জন্য বিরল অভিজ্ঞতা ছিল,” বেনারকে বলেন সনেট টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ ইয়াসিন।