ঈদের আগে পুড়ে ছাই মধ্যবিত্তের পছন্দের বঙ্গবাজার
2023.04.04
ঢাকা
ভোর ছয়টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা—এই সাড়ে ছয় ঘণ্টার মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের পছন্দের কেনাকাটার জন্য ঢাকার অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান বঙ্গবাজার। আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে সংলগ্ন আরো পাঁচটি মার্কেট।
মঙ্গলবারের এই ভয়াবহ আগুনে প্রাণহানি না ঘটলেও সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন মার্কেটের প্রায় সাত হাজার দোকান মালিক। আহত হয়েছেন দমকল বাহিনীর কমপক্ষে আট সদস্য।
অগ্নিকাণ্ডে প্রায় এক হাজার চারশো কোটি টাকার মতো আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দেওয়া হয়নি।
ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের নিকটবর্তী হওয়ায় কয়েক মিনিট দুয়েকের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছান ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। আগুনের তীব্রতা বিবেচনায় ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে।
দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস। তাদের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর সম্মিলিত সাহায্যকারী দলও কাজ করে।
আগুনের প্রকোপ ঠেকাতে একটি হেলিকপ্টারে পানি ছিটানো হয়। মাঠে নামে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবিও।
ফায়ার সার্ভিস এই আগুনের কারণ জানাতে পারেনি। ঘটনা তদন্তে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
নিঃস্ব ব্যবসায়ীরা
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ সামনে রেখে অনেক বড়ো বিনিয়োগ করেছিলেন পুড়ে যাওয়া বিপণিবিতানগুলোর প্রায় সাত হাজার দোকান মালিক। করোনার কারণে আগের ঈদগুলোতে তেমন বিক্রি না হওয়ায় এবার কিছুটা পুষিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তাঁরা।
কিন্তু ঈদের আগে বড়ো আগুনের ঘটনায় তাঁদের সে স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এই অগ্নিকাণ্ডের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারের কাছে ৭০০ কোটি টাকা দাবি করেছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “এই ব্যবসায়ীদের সব পুঁজি শেষ। তাঁদের ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসায় ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রাথমিকভাবে সরকারের কাছে আমরা সাতশ কোটি টাকা থোক বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছি।”
আগুন লাগার খবরে সকাল থেকেই বিপণিবিতানগুলোর মালিক ও দোকানিরা ঘটনাস্থলে এসে জড়ো হন। যতটা সম্ভব নিজেদের মালামাল সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আর যারা মালামাল সরাতে পারেননি, তাঁরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বেনারকে বলেন, হঠাৎ সকালে তাঁরা খবর পান, বঙ্গবাজারে আগুন লেগেছে। সঙ্গে সঙ্গে খবর পাঠানো হলে দমকল বাহিনীর সদস্যরা সেখানে আসেন। কিন্তু আগুন নেভাতে সঠিক কাজ করেননি বলে তাঁর মনে হয়েছে। ফলে মুহূর্তেই আগুন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আশেপাশে পানির উৎস না থাকায় সাধারণ মানুষ আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে পারেনি।
“চোখের সামনে পুড়ে সব শেষ। আগামীকাল কী খাব সেই নিশ্চয়তা নেই আমাদের,” বলেন রহমান।
মহানগর মার্কেট কমপ্লেক্সের পরিচালক শেখ মোহাম্মদ শাকিল মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, আগুনে মোট ছয়টি মার্কেট পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। মার্কেটগুলো হলো: বঙ্গবাজার হকার সমিতি মার্কেট, গুলিস্তান হকার সমিতি মার্কেট, মহানগরী হকার সমিতি মার্কেট, আদর্শ হকার সমিতি মার্কেট, অ্যানেক্সকো টাওয়ার ইন্টারন্যাশনাল কমপ্লেক্স এবং মহানগর কমপ্লেক্স মার্কেট।
তিনি বলেন, “এই ছয়টি মার্কেটে সাত হাজার দোকান ছিল। প্রতিটি দোকানে গড়ে ২০ লাখ টাকার মালামাল থাকলেও এই আগুনে ক্ষতি হয়েছে ১৪’শ কোটি টাকা। আমাদের ব্যবসায়ীরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পথে বসে গেছেন।”
অপেশাদারিত্বের অভিযোগ
আগুন নেভাতে আসা ফায়ার সার্ভিস বাহিনীর বিরুদ্ধে অপেশাদারিত্বের অভিযোগ এনেছে ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ী নেতা শেখ মোহাম্মদ শাকিল বলেন, “ফায়ার সার্ভিসের অপেশাদারিত্বের কারণে অথবা অবহেলার কারণে আগুন আগে নেভানো সম্ভব হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের দল আগুন লাগার দুই মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে অন্য জায়গায়।”
তিনি বলেন, “ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা প্রথমে এসে পুলিশ সদর দপ্তরের দিকে অবস্থান নেয়। তাদের মূল নজর ছিল যেন পুলিশ সদর দপ্তর ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ওই দিকে থেকে তারা পানি ছিটাচ্ছিল। যেদিকে আগুন সেদিকে তারা প্রথমে আসেনি।”
মহানগর মার্কেট কমপ্লেক্সের পরিচালক বলেন, “তারা মার্কেটের টিনের ওপর পানি ছিটাচ্ছিল এবং পানি যেখানে আগুন সেখানে না গিয়ে বৃষ্টির পানি যেভাবে টিন দিয়ে পড়ে সেভাবে পড়ে যাচ্ছিল। তারা টিনের ওপর পানি দিচ্ছিল এবং ভেতর দিকে আগুন তীব্রতর হচ্ছিল। যদি শুরুতেই যেখানে আগুন সেখানে পানি দেয়া হতো তাহলে এতো বড়ো সর্বনাশ হতো না।”
এদিকে আগুন নেভাতে অপেশাদারিত্বের অভিযোগে তুলে বঙ্গবাজার মার্কেটের কাছে ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তরে হামলা চালান বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা। মানুষের বিপদে জীবন দিয়ে হলেও এগিয়ে আসা এই বাহিনীর ওপর হামলায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক।
অভিযোগ অস্বীকার করে এই আক্রমণকে দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন দমকল বাহিনীর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাঈন উদ্দিন।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরে ঘটনাস্থলে মঙ্গলবার এক বিফ্রিংয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ২০১৯ সালে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ঝুঁকিপূর্ণ বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নোটিস টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি আমলে না নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা।
আগুন লাগার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, “এ বিষয়টি এখন বলা সম্ভব নয়। এই ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। প্রতিবেদন পাওয়ার পরে আগুন লাগার কারণ জানা যাবে।”
তিনি বলেন, বঙ্গবাজার এলাকায় অনেক বাতাস। ফলে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় দমকল বাহিনীর সদস্যদের। এছাড়া পানির অভাব ও উৎসুক জনতার ভিড়ের কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়।
ব্রিগেডিয়ার মাঈন উদ্দিন বলেন, “ফায়ার সার্ভিস সব সময় জনগণের সেবায় জীবন দেয়। শুধু আমরা আগুন নির্বাপণ করি না, জনগণের সেবায় আমরা জীবন দিই। কিন্তু আজ আমাদের সদরদপ্তরে জনগণ ঢুকে আমার গাড়ি ভাঙচুর করেছে, আমার হেডকোয়ার্টারে নতুন যে ভবন হয়েছে, সেটি ভাঙচুর করেছে। আমি খুবই মর্মাহত, আপনাদের জন্য আমরা জীবন দিই, সেই আপনারা আমাদের ওপর হামলা করলেন!”
হামলা ও আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের মোট আটজন আহত হয়েছেন জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, দুইজন দমকল কর্মী গুরুতর অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। তাঁদের শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
ঢাকা মহানগরীর অন্যতম জনপ্রিয় কেনাকাটার স্থান বঙ্গবাজারসহ বঙ্গ কমপ্লেক্স খ্যাত ফুলবাড়িয়া এলাকার মার্কেটগুলো। সস্তায় দামী ও উন্নতমানের জামাকাপড়সহ বিভিন্ন পরিধেয় সামগ্রী পাওয়া যায় সেখানে।
সেকারণে বিভিন্ন উৎসবের আগে ব্যাপক কেনাবেচা হয় এই মার্কেটগুলোতে। দেশি ক্রেতার পাশাপাশি বিদেশি ক্রেতারাও সেখানে ভিড় করেন। সারাদেশের ব্যবসায়ীরা সেখানে যান পাইকারি মালামাল কিনতে।
গুলিস্তান এলাকায় রেললাইন উঠে গেলে সেখানকার রেলওয়ের জমিতে গড়ে উঠে এই হকার্স মার্কেট। পুড়ে যাওয়া ছয়টি মার্কেটের মধ্যে দুটি ছাড়া চারটি মার্কেট সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে হকারদের পুনর্বাসনের জন্য দেয়া হয়। সেখানেই চলছিল এই মার্কেট।
বঙ্গবাজার হকার্স মার্কেটের তথ্যমতে, ১৯৯৫ সালে মার্কেটটিতে দু’বার আগুন লাগে। প্রথমবার প্রায় দুই হাজার ২০০ দোকান পুড়ে ছাই হয়ে যায়। দ্বিতীয়বারের আগুনে কিছু দোকান পুড়ে যায়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ২৪ জুলাই আগুন লেগে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের (গুলিস্তান ইউনিট) কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়।