বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি
2023.05.02
ঢাকা
বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সবচে বেশি মামলার শিকার রাজনীতিবিদ ও সংবাদকর্মীরা। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবসকে সামনে রেখে আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন সংবাদপত্র নাগরিক সংগঠন এবং রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্টরা।
মঙ্গলবার ঢাকায় মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সম্পাদক পরিষদ এই আইনটি বাতিল ও এর আওতায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের সব মামলা প্রত্যাহার এবং গ্রেপ্তারদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে।
সভায় সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে। আর যদি তা বাতিলে সরকারের কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে, তাহলে এমন একটি ধারা যুক্ত করতে হবে, যেখানে বলা থাকবে, এই আইন গণমাধ্যম, স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রযোজ্য নয়।”
“সাংবাদিকতার কারণে আজ পর্যন্ত যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তার সাংবাদিকদের মুক্তি দিতে হবে,” বলেন মাহফুজ আনাম।
ওই আলোচনা সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করে এটিকে গণমাধ্যমবান্ধব করতে হবে এবং একই সঙ্গে সাইবার জগতের নিরাপত্তার বিধানও করতে হবে।
“ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। যতক্ষণ না এটি বন্ধ করতে পারছেন, সংশোধন না করতে পারছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে মামলা দায়ের করবেন। অভিযোগ এলেই গ্রেপ্তার করে চালান দিয়ে কারাগারে পাঠাতে পারবেন না। জামিন পাওয়ার অধিকার থাকতে হবে,” সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন ইনু।
এদিকে গত শনিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটিতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে।
যদিও এই আইনের সংশোধনী নিয়ে বহুদিন থেকে কথা বলে আসছেন আইনমন্ত্রী। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে দৈনিক ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ মঙ্গলবারের আলোচনা সভায় বলেন, “আইনমন্ত্রী বারবারই বলছেন এই আইনটি সংশোধন করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না।”
মূল আসামি রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে দায়ের হওয়া মামলা নিয়ে শুরু থেকেই গবেষণাধর্মী কাজ করে আসছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)।
এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ১০ এপ্রিল পর্যন্ত এই আইনে দায়ের এক হাজার ২৯৫টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে।
এই বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মামলাগুলোতে মোট আসামি রয়েছেন তিন হাজার ৬৪৪ জন। এদের মধ্যে পেশাগত পরিচয় জানা গেছে এক হাজার ২৯৯ জনের।
পরিসংখ্যানটিতে দেখা যাচ্ছে, পরিচয় চিহ্নিত করা গেছে এমন আসামিদের মধ্যে সাংবাদিক ৩৫৫ জন বা ২৭.৩৩ শতাংশ।
এই পরিসংখ্যানমতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সবচেয়ে বেশি আসামি রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। এই তালিকায় রাজনীতিকের সংখ্যা ৪০৩ জন বা ৩১ শতাংশ। তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন ১১৮ জন শিক্ষার্থী, যা সাড়ে ৯ শতাংশ।
অপরদিকে, মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, গত চার বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলোর অধিকাংশ বাদী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি বিএনপি ও টিআইবি’র
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিবর্তনমূলক দাবি করে আইনটি বাতিলের দাবি করেছে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও দুর্নীতি বিরোধী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বিএনপি জানায়, “এই কুখ্যাত আইন বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো অন্তরায় যা গণতন্ত্রকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সরকার এই আইনের সুযোগ নিয়ে বিরোধী দলের নেতা-কর্মী, সংবাদকর্মী ও সাধারণ নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করছে।”
অপরদিকে, বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উপলক্ষে দেওয়া এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারের দায়িত্ব হলো, “গণমাধ্যম যাতে বিনা বাধায় তার ওপর অর্পিত ভূমিকা পালন করতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও ভয়হীন স্বাধীন সাংবাদিকতা ঠিক ততটাই কমেছে।”
তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন সময়ে দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যাগত তথ্য উপস্থাপন করে অন্তঃসারশূন্য আত্মতৃপ্তিলাভের চেষ্টা করতে দেখা যায়। অথচ রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় গণমাধ্যমকর্মীদের হয়রানি, হামলা ও মামলার মাধ্যমে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধসহ স্বাধীন মত ও চিন্তা প্রকাশের চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে।
“বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক ২০২২-এ এক বছরে দশ ধাপ পিছিয়ে ১৬২ তে বাংলাদেশের নেমে যাওয়া প্রমাণ করে, দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কতটা আতঙ্কজনক হারে অবনমন ঘটেছে,” বলেন ইফতেখারুজ্জামান।
অপপ্রয়োগ হচ্ছে না: প্রধানমন্ত্রী
মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে সফররত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয়েজ অব আমেরিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ সংক্রান্ত যে অভিযোগ তোলা হয় তা সত্য নয়।
শেখ হাসিনা বলেন, “ডিজিটাল আইন যেটা আছে সেটা কখনো অপপ্রয়োগ হয় না। কেউ যদি সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে বা মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি করে বা জঙ্গিবাদের ট্রেনিং দেয় বা বোমা বানানো শিখে, তাহলে এটা যদি অনলাইনে করা হয় এটার কি যৌক্তিকতা থাকতে পারে যে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায় না?”
তারপরেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এ সংক্রান্ত আইনগুলো পর্যালোচনা করে সেই আলোকে তাঁর সরকার আইনটি “সংস্কারের কাজ” করছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
এই আইন দিয়ে সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয় না দাবি করে শেখ হাসিনা বলেন, “এখন কথা হলো কেউ যদি আমার একটা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ফাইল চুরি করার চেষ্টা করে, তো তাকে কি পুরস্কৃত করতে হবে? কোনো সভ্য দেশে এটা করলে কি ব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে?”