বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনে আপত্তি: পৌর মেয়র গ্রেপ্তার

পুলক ঘটক
2021.12.01
ঢাকা
বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনে আপত্তি: পৌর মেয়র গ্রেপ্তার জাতির পিতার ম্যুরাল স্থাপনের বিরোধিতা করে মন্তব্যের জেরে মামলা হওয়ার পর রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলীকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। ০১ ডিসেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল স্থাপন প্রসঙ্গে বিতর্কিত মন্তব্যের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন রাজশাহীর কাটাখালী পৌরসভার মেয়র আব্বাস আলী।

বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো র‍্যাবের খুদে বার্তায় জানানো হয়, “রাজধানীর কাকরাইলের হোটেল রাজমনি ঈশা খাঁ থেকে আব্বাস আলীকে আটক করা হয়েছে।”

আটকের পর তাৎক্ষণিক ব্রিফিংয়ে র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন সাংবাদিকদের বলেন, “তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে দেশ ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন।”

রাজশাহীর রাজপাড়া, বোয়ালিয়া ও চন্দ্রিমা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনটি পৃথক মামলা হওয়ার পর রাজধানীর বিভিন্ন হোটেলে আত্মগোপন করে ছিলেন আব্বাস।

নিজের মতামত প্রকাশ করার দায়ে মানুষকে এভাবে গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা অনাকাঙ্ক্ষিত বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনেরা।

“বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ওই মেয়র কোনো প্রকার কটূক্তি করেননি, ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপনে আপত্তি জানিয়েছেন। এই অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে,” বেনারকে বলেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।

আর্টিকেল ১৯-এর দক্ষিণ এশিয়া ও বাংলাদেশ শাখার পরিচালক ফারুক ফয়সাল বেনারকে বলেছেন, “দেশে নানারকম অন্যায় হচ্ছে। মানুষের মতামত প্রকাশের সুযোগ নেই বললেই চলে। সরকারের আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধেও কোনো কথা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু একজন তাঁর বিশ্বাস বলতে পারবেন না কেন?”

গত ২২ নভেম্বর রাত থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি অডিও রেকর্ডে আব্বাসকে বলতে শোনা যায়, “রাজশাহী সিটি গেইটে বঙ্গবন্ধুর যে ম্যুরাল করার নকশা দেওয়া হয়েছে, সেটা ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী সঠিক নয়। এটা করতে দিলে পাপ হবে।”

পরদিন (২৩ নভেম্বর) রাতে মেয়র আব্বাস আলীর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজশাহীর তিনটি থানায় আলাদা তিনটি মামলা দায়ের করেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ের তিন নেতা।

প্রথমে অস্বীকার এবং চক্রান্ত বলে দাবি করলেও গত ২৬ নভেম্বর ফেসবুক লাইভে এসে আব্বাস আলী ফেসবুকে ও মেসেঞ্জারে ছড়িয়ে পড়া অডিও রেকর্ডের কণ্ঠ তার নিজের বলে স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, স্থানীয় একটি মাদ্রাসার বড়ো হুজুরের পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে তিনি ম্যুরাল না রাখার বিষয়টি কথাচ্ছলে বলেছিলেন। তিনি ভুল করার কথা জানিয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ক্ষমা চান।

আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে টানা দুই মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব আছেন আব্বাস আলী। রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। তাঁর ওই কণ্ঠস্বর ভাইরাল হওয়ার পর গত ২৪ নভেম্বর বিকেলে পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে জরুরি বৈঠকে আব্বাসকে পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁকে মেয়র পদ থেকে অপসারণের জন্য অনাস্থাও এনেছেন পৌরসভার কাউন্সিলররা।

সম্প্রতি প্রায় একই ধরনের একটি ঘটনায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং তিনিও সাময়িকভাবে মেয়র পদ হারান। এর পরপরই কাটাখালীর পৌর মেয়রের বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তাঁকে অপসারণের দাবিতে রাজশাহীতে আন্দোলন শুরু করে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ।

বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটূক্তি নেই’

কিছুদিন আগে মেয়র আব্বাস আলী একটি ঘরোয়া বৈঠকে রাজশাহী-ঢাকা মহাসড়কের কাটাখালী পৌরসভার অংশের উন্নয়নকাজ নিয়ে কথা বলার সময় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল স্থাপন নিয়ে তাঁর আপত্তির কথা প্রকাশ করেন।

এরপর ২২ নভেম্বর রাত থেকে মেয়রের দুটি অডিও রেকর্ড ভাইরাল হয়। অডিওতে মেয়রকে বলতে শোনা যায়, “একটু থাইমি গেছি গেটটা নিয়ে, একটু ডিজাইন চেঞ্জ করতে হচ্ছে। বড়ো হুজুরের সঙ্গে আমাদের এক লোক বসেছিল, যে ম্যুরালটা দিছে বঙ্গবন্ধুর, এটা ইসলামি শরিয়ত মোতাবেক সঠিক না। ...আমি দেখতে পাচ্ছি যে, ম্যুরালটি ঠিক হবে না দিলে। আমার পাপ হবে। তো কেন দিব? দিব না, আমি তো কানা লোক না, আমাক বুঝাই দিছে। এজন্য আমি ওটাকে চেঞ্জ করছি।”

এক মিনিট ৫১ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপটিতে মেয়র আব্বাসকে বলতে শোনা যায়, “ওই গেটটি দ্রুত নির্মাণ হবে। তবে আমরা যে ফার্মকে কাজটি দিয়েছি, তারা গেটের ওপর বঙ্গবন্ধুর যে ম্যুরাল বসানোর ডিজাইন দিয়েছে, সেটি ইসলামের দৃষ্টিতে সঠিক না। তাই আমি সেটিকে বাদ দিতে বলেছি।”

মেয়র আব্বাসের এই বক্তব্য এবং গ্রেপ্তার সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “এই বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটূক্তি নেই। কাটাখালীর মেয়র সাহেব তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কিছু কথা বলেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে অসম্মান করেননি।”

“আমি ব্যক্তিগতভাবে মেয়রের ওই ধারণার সঙ্গে একমত নই। কিন্তু ওই বক্তব্যের জন্য তাঁর এমন দশা হওয়ার কথা না,” যোগ করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে মেয়রের এই বক্তব্য আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই ধর্মাশ্রয়ী প্রবণতার জন্য রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতাই দায়ী। সমাজে ও রাজনীতিতে ধর্মাশ্রয়ী দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রভাব প্রতিপত্তি বেড়েছে। তাই মেয়র যে কথা বলেছেন সেটি বড়ো করে না দেখে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য প্রকৃত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে,” বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।