রানা প্লাজা ধস: হাজারের বেশি শ্রমিক হত্যার বিচার আটকে আছে আট বছর
2021.04.23
ঢাকা
আট বছর আগে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় এগারোশ’র বেশি শ্রমিক মারা গেলেও হত্যা মামলার সেই বিচার এখনো সাক্ষ্য পর্যায়ে পৌঁছেনি, মামলাটি উচ্চ আদালতেই স্থগিত হয়ে আছে। এই মুহূর্তে একজন ছাড়া সব আসামি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বেনারকে বলেন, “অভিযুক্তদের মধ্য থেকে দুজন আসামিকে হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে বিচার করার সিদ্ধান্ত ঠিক আছে কি না, সে বিষয়ে হাইকোর্টে দায়ের করা দুটি আপিল এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি।”
তাঁর মতে, রাষ্ট্রপক্ষ স্থগিতাদেশ বাতিল করতে পারলে নিম্ন আদালতে শুনানি শুরু হতো। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ সেই চেষ্টা করছে বলে মনে হয় না।
হত্যা মামলায় ৪১ অভিযুক্তদের মধ্যে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ছাড়া সবাই জামিন পেয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার মক্কেল সোহেল রানা ২০১৩ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত টানা আট বছর বিনা বিচারে জেল খাটছেন।”
“অথচ শুধু মাত্র এই ভবনটি তাঁর নামে হওয়া ছাড়া কোনো কিছুর সাথেই তিনি জড়িত নন। ভবনটিতে যে চারটি পোশাক কারখানা ছিল, তার মালিকরাও কিন্তু জামিনে মুক্ত হয়েছেন,” যোগ করেন তিনি।
আসামি পক্ষের আইনজীবীর অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি মো. মিজানুর রহমান বেনারকে বলেন, “রানা প্লাজা ধসে এতগুলো মানুষের হত্যার অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, তাঁকে আদালত জামিন দেবে কীভাবে?”
অভিযোগ গঠনের পর আটজন অভিযুক্ত উচ্চ আদালতে রিভিশনের আবেদন করেন, তার মধ্যে ছয়জনের আবেদন বাতিল হয়ে গেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “উচ্চ আদালতে ওই মামলাটি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস দেখভাল করছে।”
বাকি দুজনকে বাদ দিয়ে বা তাঁদের আবেদন নিষ্পত্তি করে কীভাবে মামলা চালানো যায় সে বিষয়ে জানতে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে এ পর্যন্ত তাঁরা চারটি চিঠি দিয়েছেন।
এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের সাথে “শিগগিরই” তাঁরা দেখা করবেন বলেও জানান মিজানুর রহমান।
অভিযুক্ত ৪১ জনের ভেতর ইতিমধ্যে রানার বাবা আবদুল খালেকসহ তিনজন মারা গেছেন ও ছয়জন পলাতক বলেও জানান তিনি।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর মোট তিনটি মামলা দায়ের হয়, যেগুলোর কোনোটিতেই তেমন অগ্রগতি নেই।
এর মধ্যে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলাটি করে পুলিশ, ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), আর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভবন নির্মাণসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে করে আরেকটি মামলা।
এর বাইরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তলবে সম্পদের হিসাব দাখিল না করার মামলায় ২০১৭ সালে রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয় ঢাকার একটি আদালত।
“আট বছরেও এতগুলো শ্রমিক হত্যার বিচার হলো না। আসামিরা জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা শ্রমিকদের সাথে প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়,” এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন শ্রমিক নেতা তাসলিমা আক্তার।
২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিল ঢাকার অদূরে সাভারে নয় তলা রানা প্লাজা ভবন ধসে ১ হাজার ১৩৬ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। ওই ভবনে বেশ কয়েকটি তৈরি পোশাক কারখানা ছিল যেগুলো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করত।
কেমন আছেন আহতরা?
“রোজার প্রথম নয়দিনে একবারের জন্যও ভালো ইফতার জোটেনি। কোনো রকমে একবেলা খাবার জুটছে। এখন যা পরিস্থিতি তাতে মনে হয়, দুর্ঘটনায় সেদিন মারা গেলেই বরং ভালো হতো,” বেনারের কাছে এভাবেই দুর্বিষহ জীবনের গল্প বলছিলেন সাভারের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত শ্রমিক সবেদা বেগম মুক্তা।
সেদিনের ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ভাঙা পায়ে কয়েকবার অপারেশন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখন কিছুটা ভালো। তবে টানা পাঁচ মিনিট হাঁটাচলা করতে পারি না। কাঁধ ও মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে নানা রকম সমস্যা। তাই কাজ করতে পারি না।”
পাবনা থেকে মোবাইল ফোনে মুক্তা বেনারকে বলেন, “করোনায় কত রকম সাহায্যের কথা শুনেছি। কিন্তু আমরা কিছুই পাইনি। রোজার মাস শেষ হলেই ঈদ, আগামী দিনগুলো কীভাবে চলবে তা জানি না।”
ওই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়ার আরেক শ্রমিক নাসির উদ্দিন সাভারে থাকলেও পোশাক কারখানার কাজ ছেড়ে দিন মজুরের কাজ করেন। শুক্রবার বেনারকে তিনি বলেন, “হাত–পা ভেঙে গিয়েছিল। ভারি কাজ করতে পারি না। করোনার কারণে এখন ঘরেই বসে আছি।”
দুর্ঘটনার পর সরকারি-বেসরকারি অনুদানগুলো আলাদা আলাদাভাবে পাওয়ায় “সেটা কোনো কাজে লাগাতে পারিনি,” জানিয়ে নাসির উদ্দিন বলেন, “হঠাৎ হঠাৎ সেদিনের দুর্ঘটনার কথা মনে পড়ে। তখন দুঃসহ মনে হয় সব কিছু।”
আহতদের ৫৭ শতাংশ বেকার
রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত এক হাজার চারশ শ্রমিকের ডাটাবেজ থেকে দুইশ জনকে নমুনা হিসেবে নিয়ে গবেষণা করেছে বেসরকারি সংস্থা একশনএইড।
করোনাকালে ওই ঘটনায় আহত শ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে অ্যাকশন এইড বলছে, ২০১৯ সালে ৫১ শতাংশ শ্রমিক বেকার ছিলেন। গত বছর সেটি বেড়ে ৫৭ শতাংশ হয়েছে, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের আট বছর পূর্তি উপলক্ষে একশনএইড বৃহস্পতিবার ভার্চুয়াল মাধ্যমে জরিপের এই ফলাফল প্রকাশ করে।
এতে বলা হয়, আহত ব্যক্তিদের মধ্যে কাজে থাকা ৪৩ শতাংশ শ্রমিকের ১২ শতাংশ পোশাক কারখানায় ও ১২ শতাংশ কর্মরত আছেন দরজি হিসেবে। বাকিরা অন্যান্য পেশায় যুক্ত।
যারা কাজে যুক্ত আছেন তাঁদের ১০ শতাংশের মাসিক আয় ৫ হাজার ৩০০ টাকার নিচে বলেও জানানো হয় জরিপের ফলাফলে।
তবে আহতদের সকলেই “দুর্ঘটনার পর যথেষ্ট পরিমাণ সরকারি-বেসরকারিভাবে অনুদান পেয়েছিলেন,” বলে বেনারকে জানান শ্রম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শ্রম অনুবিভাগ) ড. মো. রেজাউল হক।
এছাড়া আহতদের মধ্যে যারা আবার পোশাক শ্রমিকের পেশায় ফিরে এসেছেন তাঁরা করোনাকালে সরকারের দেওয়া বিশেষ প্রণোদনাসহ সব সুবিধা পেয়েছেন বলেও জানান তিনি।
“আর যারা এই পেশায় নেই, তাঁরা সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় এসেছেন বলে আশা করা যায়,” বলেন ড. রেজাউল।
কর্মক্ষেত্র ঝুঁকিমুক্ত হয়নি
একশনএইডের জরিপ বলছে, ৬৭ শতাংশ মানুষ কারখানাগুলোতে সঠিক নিয়মনীতি ও কর্মঘণ্টা বজায় রাখার কথা স্বীকার করলেও ৩৩ শতাংশ বলছেন কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়েই কাজ করেন তাঁরা। কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি তেমন মানা হচ্ছে না বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন তাঁরা।
এ বিষয়ে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির প্রধান সমন্বয়ক তাসলিমা আক্তার বেনারকে বলেন, “রানা প্লাজা ধসের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের মজুরি, নিরাপত্তা, ট্রেড ইউনিয়নের প্রশ্ন আরো অনেকগুলো বিষয় সামনে এনেছে। তবে তা অনেকগুলো জীবনের বিনিময়ে।”
“তারপরেও খুব বেশি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। নিরাপত্তার বিষয়ে সবখানে কিছুটা পরিবর্তন দেখা গেলেও তা শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে বলা যায় না। এখন পর্যন্ত যা মজুরি তা খুবই কম,” বলেন তাসলিমা আক্তার।
“রানা প্লাজার দুর্ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক” মন্তব্য করে শ্রম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রেজাউল হক বলেন, “এটি ছিল আমাদের পোশাক খাতের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। ওই ঘটনার পরে দেশের পোশাক খাত অন্য দেশে চলে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল।”
তবে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহযোগিতা ও সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ওইসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এই খাতে “বহুমাত্রিক পরিবর্তন” আনার ফলে “আমাদের পোশাক খাত টিকে গেছে এবং রপ্তানিও বহুগুণে বেড়েছে,” জানান তিনি।
এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দুই সপ্তাহের টানা লকডাউন ঘোষণা করা হলেও গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ করা হয়নি।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক কে এম মিন্টু বেনারকে বলেন, লক ডাউন চললেও দেশে শতভাগ গার্মেন্টস কারখানাই খোলা রয়েছে।
“এই মুহূর্তে বড়ো কোনো শ্রমিক আন্দোলন নেই। তবে কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি না থাকা, নিজস্ব যাতায়াতের ব্যবস্থা না করার মতো বিষয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে,” জানান ওই শ্রমিক নেতা।