গুলিতে পোশাক শ্রমিক নিহত, টিয়ার শেলে ছত্রভঙ্গ চাকরিপ্রার্থীরা
2024.09.30
ঢাকা
বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এই নিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে দুইজন পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু দেখল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
সোমবার দুপুর ১২টার দিকে শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার টঙ্গিবাড়ী এলাকায় শ্রমিক ও যৌথবাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে কাউসার হোসেন খান (২৬) নামে একজন শ্রমিক নিহত হন। তিনি ম্যাঙ্গোটেক্স লিমিটেডের অপারেটর ছিলেন।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম ক্ষুদে বার্তায় গুলিতে একজন নিহত ও চারজন আহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন। তিনি নিজেও গুরুতর আহত হয়ে সিএমএইচে ভর্তি আছেন বলে জানান।
তবে শ্রমিকদের দেওয়া তথ্য মতে, এ ঘটনায় পাঁচজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন।
এনাম মেডিকেলের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. এনামুল হক সাংবাদিকদের জানান, কাউসারকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। তাঁর তলপেটে গুলি লেগেছিল। এছাড়া আরো দুই জনের বুকে গুলি লেগেছে। তাঁদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। একজনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করা হয়েছে।
অধিকারের জন্য আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি চালানোর ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন শ্রমিক ফেডারেশন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, শ্রমিকরা যে কারণেই আন্দোলন করুক না কেন, তাদের হাতে অস্ত্র ছিল না। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে না গিয়ে, নিয়মের তোয়াক্কা না করে নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর গুলি চালাল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
“এই পরিস্থিতি ভীষণ উদ্বেগজনক। মনে হচ্ছে নতুন সরকারের সাথে পুরোনো ক্ষমতাসীনদের মধ্যে পার্থক্য নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার চলছেই,” বলেন তিনি।
এর আগে গত মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) কারখানার উৎপাদন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফেরাতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ১৮টি দাবির প্রায় সবগুলোই মেনে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই হয়। এরপরেও সোমবার আশুলিয়ার কয়েকটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার বেনারকে বলেন, “১৮ দফা দাবি মানার পরেও শ্রমিকদের আন্দোলন যেখানে চলছে, সেটা আমাদের ফেডারেশনগুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কাদের উস্কানিতে এই আন্দোলন চলছে সেটা আমরা জানি না। সরকারের উচিত তাদের খুঁজে বের করা। তবে এভাবে কর্মীদের উপর গুলি করা মেনে নেওয়া যায় না।”
ঘটনাস্থলে উপস্থিত একাধিক শ্রমিক জানান, সোমবার সকালে মন্ডল নিটওয়্যার লিমিটেড খুলে দেওয়া, দুজন শ্রমিক নিখোঁজের অভিযোগ ও শ্রমিকদের মারধরসহ নানা বিষয় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শ্রমিক ও মালিকপক্ষ আলোচনায় বসে। একপর্যায়ে শ্রমিকেরা বাইরে বের হয়ে আসেন। এ সময় মন্ডলের শ্রমিকদের আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে- এমন কথা ছড়িয়ে পড়লে পাশের দুটি কারখানার শ্রমিকেরা বের হয়ে বিক্ষোভ করতে থাকেন। আশপাশের আরো কিছু কারখানার শ্রমিকেরাও সেখানে যোগ দেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শ্রমিকদের ধাওয়া দেন। পরে উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলিতে কয়েকজন হতাহত হন।
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “কর্তৃত্ববাদের জঞ্জাল থেকে বের হওয়ার পর চট করে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে এমনটি আশা করা যায় না। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে আইনশৃঙ্খলা, অর্থনীতিসহ অগ্রাধিকার ঠিক করে যতদ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে হবে।”
“গত ৫ আগস্টের পর যে শ্রমিক আন্দোলন দেখা যাচ্ছে তা কেবল শ্রমিকদের অধিকারভিত্তিক নাকি এর পেছনে অন্য কিছু আছে তা খতিয়ে দেখতে হবে। গুলি করার পেশাগত ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানা হয়েছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখে কারো দায় থাকলে ব্যবস্থা নিতে হবে,” বলেন ড. ইফতেখার।
মানবাধিকার কর্মী খুশি কবির বেনারকে বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এই সময়টি বেশ কঠিন। তবে যে কোনো ধরনের সহিংসতা ও প্রতিবাদ নিয়ন্ত্রণে স্বৈরাচারী ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি চাই না।”
চাকরিপ্রার্থীদের ওপর পুলিশের টিয়ারশেল
এদিকে ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে সরকারি চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে আন্দোলনকারীদের টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ।
এ ছাড়া ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ছাত্র ও পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ ও মানববন্ধনের কারণে রাজধানীবাসীর জীবনযাত্রা অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে। প্রচণ্ড যানজট ও দুঃসহ গরমে নগরবাসীর জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে।
সোমবার রাজধানীর পান্থপথে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চের পরিচালকের অপসারণসহ বিভিন্ন দাবি আদায়ে আন্দোলনে নামে শিক্ষার্থীরা। জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় ছিল কয়েকটি বিক্ষোভ-মানববন্ধন।
এদিন বেলা ১টার দিকে রাজধানীর মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার প্রজ্ঞাপন না নিয়ে অবস্থান ছাড়বেন না বলে ঘোষণা দেন তারা।
এ সময় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ারগ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সোমবার বেনারকে বলেন, চাকরির বয়স বাড়ানোর দাবিতে শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি আদায়ে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে জড়ো হয়।
“কিন্তু জায়গাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার আওতায় পড়ে। এই এলাকায় আন্দোলন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে,” তিনি বলেন।
“তাদের ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারগ্যাস এবং সামান্য লাঠিচার্জ করতে হয়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে,” বলেন তালেবুর রহমান।
গত ২৬ আগস্ট এক গণবিজ্ঞপ্তিতে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বাংলাদেশ সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার আশপাশের এলাকায় সব ধরনের সভা, সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
তবে যমুনায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলামের সঙ্গে বৈঠকের পরে সোমবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে থেকে সরে যান আন্দোলনকারীরা।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি রাসেল আল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “দাবি বাস্তবায়নের জন্য আগামীকাল জনপ্রশাসন সংস্কার উপদেষ্টা আব্দুল মুহিতের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হবে। সেখানে যে কার্যকর আলোচনা হবে, তার একটি প্রতিবেদন আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে।”