পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীকে ব্র্যান্ডগুলোর অনুরোধ

রিয়াদ হোসেন
2023.10.18
ঢাকা
পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীকে ব্র্যান্ডগুলোর অনুরোধ পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা নির্ধারণের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শ্রমিকদের বিক্ষোভ। ১৩ অক্টোবর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

চলমান মূল্যস্ফীতিকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে বিশ্বের ১৫টি ব্র্যান্ড।

যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ডগুলোর সংগঠন আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন(এএএফএ) গত ১৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা এক চিঠিতে এই অনুরোধ জানায়। চিঠিটি তারা নিজেদের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করেছে।

এতে বলা হয়, “২০১৯ সাল থেকে শ্রমিকদের গড় মাসিক মজুরি সমন্বয় করা হয়নি, অথচ এই সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।”

“ন্যূনতম মজুরির স্তর এমনভাবে বাড়ানো উচিত, যাতে শ্রমিকরা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে এবং তাতে যেন মূল্যস্ফীতির বিষয়টিকেও বিবেচনায় নেওয়া হয়,” বলা হয় চিঠিতে।

শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি পেলে ব্র্যান্ডগুলো এগিয়ে আসবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় চিঠিতে।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বোর্ড গত ১০ এপ্রিল গঠন হওয়ার ছয় মাস পার হলেও ওই বোর্ড শ্রমিকদের জন্য সুপারিশ করতে ব্যর্থ হয়ে বাড়তি তিন মাস সময় চেয়েছে।

এদিকে মজুরি বোর্ডের বাড়তি তিন মাস সময় চাওয়ায় মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন শ্রমিক নেতারা। তাঁদের মতে, ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোলের নিচে শ্রমিকদের মজুরির বিষয়টি ধামাচাপা পড়তে পারে।

ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিজিএমইএ

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে ব্র্যান্ডগুলোর এগিয়ে আসার উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।

এ প্রসঙ্গে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বুধবার বেনারকে বলেন, “শ্রমিকের বর্ধিত মজুরি দিতে ব্র্যান্ডদের এগিয়ে আসার এমন উদ্যোগকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। কেননা তাদের সহযোগিতা ছাড়া আমরা নতুন বর্ধিত মজুরি বাস্তবায়ন করতে পারব না।”

গত ২০ সেপ্টেম্বর বিজিএমইএ সভাপতি পোশাকের দর নিয়ে আলোচনায় বর্ধিত মজুরির বিষয়টি বিবেচনায় রাখার অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাক নেওয়া ব্র্যান্ডগুলোকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, আগের মজুরি ও গত পাঁচ বছরের মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় শ্রমিকদের মজুরি ‘উল্লেখযোগ্য’ হারে বাড়তে পারে।”

শ্রমিকের জীবনযাত্রার ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে পোশাকের ‘যৌক্তিক’ দর বাড়ানোর ব্যাপারটি বিবেচনা করার অনুরোধ জানান তিনি।

গত দুই বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। সরকারি পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, গত আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যা এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ। এ কারণে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমে গেছে বলে মনে করছেন শ্রমিক নেতারা।

বর্তমানে বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা। এই মজুরি ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো ব্র্যান্ডগুলোর চিঠির ব্যাপারে জানতে শ্রম ও কর্মস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. এহছানে এলাহীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তাঁরা রিসিভ করেননি। বিষয়বস্তু জানিয়ে শ্রম সচিবকে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও জবাব পাওয়া যায়নি।

মজুরি বৃদ্ধির অনুরোধ করে সরকারকে চিঠি পাঠানো ১৫টি ব্র্যান্ডের তালিকায় রয়েছে এডিডাস, পুমা, গ্যাপ ইনক, হুগো বস এজি, পিভিএইচ, লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কোম্পানি, বার্টন। এর মধ্যে নয়টি যুক্তরাষ্ট্রের।

বেনারের পাঠানো মেইলের জবাবে পুমার কমিউনিকেশন্স বিভাগের পক্ষ থেকে সামান্থা ডু প্লেসিস জানান, মজুরি বৃদ্ধির পরও প্রতিষ্ঠানটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে তাদের পণ্য ক্রয় অব্যাহত রাখবে।

পুমার পক্ষ থেকে জানানো হয়, শীর্ষ ছয়টি সরবরাহকারী দেশের একটি হলো বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি তাদের মোট ক্রয়ের ১২ শতাংশ বাংলাদেশ থেকে নেয়।

মজুরি বোর্ডে শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধি ও জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বেনারকে বলেন, “মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকের প্রকৃত আয় কমে গেছে। আমরা চাই মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ মজুরি হোক।”

বিশ্বের অন্যতম কম মজুরির দেশ হিসেবে দুর্নাম রয়েছে বাংলাদেশের। শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, নয়টি দেশের পোশাক খাতের শ্রমিকের মজুরির তুলনায় বাংলাদেশে মজুরি সবচে কম।

বাংলাদেশে পোশাক শ্রমিকদের মাসিক মজুরি ৭৫ দশমিক পাঁচ ডলার (বর্তমানে ৭৩ ডলার)। একই সময়ে চীনে ২৬২ ডলার, ভারতে ১২৮ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ১৩৭ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১৯৪ ডলার, মালয়েশিয়ায় ২৫০ ডলার, ফিলিপাইনে ২৪৪ ডলার, ভিয়েতনামে ১৬৮ ও তুরস্কে ৩০৭ ডলার।

KSR_7075.JPG
নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা এলাকার একটি পোশাক তৈরির কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করছেন। ১৪ আগস্ট ২০২৩। [বেনারনিউজ]

সময় চেয়েছে মজুরি বোর্ড

গত ১০ এপ্রিল মজুরি বোর্ড গঠন হওয়ার ছয় মাস পার হলেও মজুরি বোর্ড শ্রমিকদের জন্য সুপারিশ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গত ১১ অক্টোবর আরও তিন মাস সময় চেয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছে মজুরি বোর্ড।

মালিক কিংবা শ্রমিক “কোনো পক্ষই মজুরির প্রস্তাব দিতে পারেননি। এ জন্য সময় বাড়ানো হয়েছে,” বলে বেনারকে জানান বোর্ডের সচিব রাইসা আফরোজ।

ছয় মাসের মধ্যে মজুরি ঘোষণা না করে বোর্ডের নতুন করে তিন মাস সময় নেওয়া “অযৌক্তিক” হিসেবে মন্তব্য করে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বেনারকে বলেন, “এই সময়ের মধ্যে নির্বাচনী ডামাডোল শুরু হয়ে যাবে এবং এতে করে হয়তো ব্যাপারটি ঝুলে যাবে।”

শ্রমিকরা নভেম্বরের মধ্যে নতুন মজুরি ঘোষণা হবে এমন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে আছেন জানিয়ে তিনি বলেন, “এই সময়ের মধ্যে মজুরি সমন্বয় না হলে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি হতে পারে।”

ছয় মাসের মধ্যেই বোর্ডের নতুন মজুরি ঘোষণা করা উচিত ছিল বলে মনে করেন শ্রম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু।

তিনি বেনারকে বলেন, “এত সময় বাড়ানোর দরকার ছিল না। শ্রমিকরা এখন কষ্টকর সময় পার করছেন।”

তবে রাইসা আফরোজের মতে, “নির্বাচনের কারণে মজুরি ঝুলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এতে আইনগত ব্যত্যয় হয়নি।”

সময় চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “বারবার তো সময় চাওয়া যায় না। এ জন্য আমরা একবারেই সময় চেয়েছি। যদিও এত সময় লাগবে না। নভেম্বরের মধ্যে নতুন মজুরির সুপারিশ জমা হতে পারে।”

দাবি ন্যূনতম ২৩ হাজার টাকা

মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সভা-সমাবেশ করা শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রায় প্রত্যেকের দাবি মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ২৩ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির ঘোষণা।

এ প্রসঙ্গে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার বেনারকে বলেন, “আমরা যে সময় এ মজুরির প্রস্তাব দিয়েছি, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে।”

এ ব্যাপারে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান তাঁদের প্রস্তাবনার ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি।

তবে তিনি বলেন, তাঁরা “শিল্পের সক্ষমতা অনুযায়ী” মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দেবেন। কারণ ব্রান্ডগুলোর কথা অনুযায়ী মজুরি বাড়ালে পরে তারা বাংলাদেশের “পণ্য নাও কিনতে পারে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।