মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রম অসন্তোষে বন্ধ ৫০০ পোশাক কারখানা
2023.11.02
ঢাকা
দেশের সবচেয়ে বড়ো রপ্তানিখাত তৈরি পোশাক শিল্পে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রম অসন্তোষের জেরে একের পর এক পোশাক কারখানা বন্ধ হলেও সরকার বা মালিকপক্ষ গত দশদিনে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি।
হরতাল ও রাজনৈতিক অবরোধের কারণে এমনিতেই এই খাতের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তার ওপর টানা শ্রমিক অসন্তোষে বড়ো ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে এই শিল্পটি।
তিন দিনের টানা অবরোধ শেষে রোববার থেকে দুই দিনের অবরোধ ডেকেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। রোববার ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সারাদেশে সর্বাত্মক এই অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হবে।
পোশাক শিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার নতুন করে আরো অন্তত ৫০টি কারখানা বন্ধ হয়েছে।
“বৃহস্পতিবার নতুন করে আরো ৫০টি কারখানা বন্ধ করায় সব মিলিয়ে ৫শ’ কারখানা বন্ধ রয়েছে,” বলে বেনারকে জানান বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরে সড়ক অবরোধ করে রাখা শ্রমিকদের উপর পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছে। সাভারের আশুলিয়ায় শ্রমিকরা অন্তত দুটি কারখানায় ভাংচুর চালিয়েছেন।
গত ২২ অক্টোবর মজুরি বোর্ডে মালিকপক্ষ বিদ্যমান ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০ হাজার চারশো’ টাকা করার প্রস্তাব দেয়। আর শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা প্রস্তাব দেন ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা।
মালিকপক্ষের প্রস্তাবের প্রতিবাদে পরদিন থেকে ঢাকার অদূরে গাজীপুরে কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা ২৩ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে সড়ক অবরোধ করার পর ধীরে ধীরে অন্যান্য কারখানার শ্রমিকরাও আন্দোলনে যোগ দেন। গাজীপুর থেকে আন্দোলন চলে আসে ঢাকা শহরের মধ্যে, যেখানে নগরবাসী হরতাল-অবরোধে এমনিতেই অসহনীয় অবস্থায় রয়েছেন।
এর আগে গত সোমবার পুলিশের সাথে সংঘর্ষে এক শ্রমিকসহ দুই জন নিহত হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে আশুলিয়া ও ঢাকার মিরপুর এলাকায়।
মিরপুরে শ্রমিকদের ওপর কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ
রাজধানীর মিরপুর-১১ নম্বরে সড়ক অবরোধ করে রাখা শত শত শ্রমিকের ওপর কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোঁড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অবরোধে অংশ নেয়া শ্রমিক মোহাম্মদ হাসান বেনারকে বলেন, “বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করার পর আমরা গলির মধ্যে চলে যাই। গলিতেও পুলিশ আমাদের ধাওয়া করেছে।"
তবে পুলিশের মতে, শ্রমিকরা গাড়ি ভাঙচুর করার সময় তাঁদের সরিয়ে দিতে কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করতে হয়েছে।
ডিএমপির পল্লবী জোনের সহকারী কমিশনার শহীদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, শ্রমিকরা মিরপুর-১২ তে একটি গাড়ি ভাঙচুর করেছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের কাছে খবর ছিল শ্রমিকদের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী রয়েছে। এরপর আমরা সিনিয়র কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সামান্য কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেডের মাধ্যমে তাদের মূল সড়ক থেকে সরিয়ে দেই। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে আটক করা হয়েছে।”
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের এসপি মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার সকালে বাসন থানা এলাকার ভোগড়া বাইপাস এলাকায় শ্রমিকরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়।”
আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ জানিয়েছে, সেখানে দুটি কারখানায় শ্রমিকরা ভাঙচুর চালিয়েছেন।
কত সংখ্যক কারখানা বন্ধ, সে বিষয়ে শিল্পাঞ্চল পুলিশের কাছ থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে গাজীপুরে বন্ধ কারখানা ১৭০টি বলে জানিয়েছেন সরোয়ার আলম।
মালিকপক্ষের মজুরি প্রস্তাব অযৌক্তিক: শ্রম প্রতিমন্ত্রী
মালিকপক্ষের মজুরি প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলে মনে করছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। বৃহস্পতিবার বিকেলে শ্রমিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মালিকপক্ষের ১০ হাজার ৪শ’ টাকার প্রস্তাব অবশ্যই অযৌক্তিক।”
“গত ৫ বছরে প্রতি বছরে পাঁচ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির কারণে এমনিতেই শ্রমিকদের বেতন প্রায় ১০ হাজার ৪০০ টাকা হয়ে গেছে। তাই এটা কি গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব হলো?” প্রশ্ন রাখেন তিনি।
আগামী ৭ নভেম্বর মজুরি বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে তাই শ্রমিকদের দ্রুত কাজে ফেরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব গ্রহণযোগ্য মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা হবে।”
এ সময় শ্রমিকদের আন্দোলনে ঢুকে জ্বালাও পোড়াওয়ের জন্য তিনি বর্তমানে অবরোধে থাকা বিরোধী দলগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করেন।
বৈঠকে উপস্থিত শ্রমিক নেতারাও সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণের জন্য মন্ত্রীকে অনুরোধ করেন।
সভায় উপস্থিত ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সাবেক মহাসচিব তৌহিদুর রহমান বেনারকে বলেন, “যতই সময়ক্ষেপণ হবে, ততই শিল্পের ক্ষতি হবে। আমরা মন্ত্রীকে বলেছি, শ্রমিকদের ইতিবাচক বার্তা দিয়ে ঘরে ফেরাতে হবে।”
শনিবার সব কারখানা খুলতে চায় মালিকপক্ষ
আগামী শনিবার সব কারখানা খোলা হবে বলে বেনারকে জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, “আমরা সব কারখানা মালিককে জানিয়ে দিয়েছি, শনিবার (৪ নভেম্বর) সব কারখানা খোলার জন্য। যদি কোনো ভাঙচুর হয়, বা শ্রমিকরা কাজ না করে, তাহলে শ্রম আইনের ১৩/১ ধারা অনুযায়ী কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে।”
প্রসঙ্গত, শ্রম আইনের আলোচ্য ধারা অনুযায়ী, বেআইনি ধর্মঘটের জন্য কারখানা বন্ধ করা যায়। ফলে যত সময়ের জন্য কারখানা বন্ধ থাকবে, ওই সময়ের জন্য শ্রমিকরা কোনো মজুরি পাবেন না।
অন্যান্য কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁরা শনিবার কারখানা চালু করবেন। কারখানায় কোনো হামলা হলে কিংবা শ্রমিকরা কাজ করতে না চাইলে ‘কাজ নয়, বেতন নয়’ এই ব্যবস্থায় কারখানা বন্ধ করবেন।
লোকসানের শঙ্কায় রপ্তানিকারকরা
দেশের সবচেয়ে বড়ো রপ্তানিখাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কারখানা বন্ধ হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন রপ্তানিকারকরা।
নিট এশিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মতিন চৌধুরী বেনারকে বলেন, “আমার দুটি কারখানা বন্ধ। উৎপাদন না হওয়ায় সময়মতো পণ্য তৈরি করতে পারছি না। আবার অবরোধের কারণে তৈরি পণ্য বন্দরে পাঠানো যাচ্ছে না।”
এর ফলে ক্রয়াদেশ বাতিল হতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে বড়ো ধরনের আর্থিক লোকসান হতে পারে।
তিনি বলেন, এতদিনে আমাদের যে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিলো, তা শ্রম অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশী ক্রেতাদের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। ফলে তারা ক্রয়াদেশ দেওয়ার জন্য বিকল্প খুঁজবে। এছাড়া শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠবে।
শ্রমিক অসন্তোষ ছাড়ও রাজনৈতিক অবরোধের কারণে কী পরিমাণ লোকসান হচ্ছে, বিজিএমইএ তার হিসাব করছে বলে বেনারকে জানিয়েছেন সংগঠনটির সহ-সভাপতি মো. নাসির উদ্দিন।