পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা, খুশি নন শ্রমিকরা

রিয়াদ হোসেন
2023.11.07
ঢাকা
পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা, খুশি নন শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে ঢাকার তোপখানা রোডে মজুরি বোর্ডের সামনে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ। ৭ নভেম্বর ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

পাঁচ বছর পর ঘোষিত নতুন মজুরি কাঠামোতে শ্রমিকদের দাবির চেয়ে কয়েক হাজার টাকা কম মজুরি চূড়ান্ত করেছে সরকার। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছেন পোশাক শ্রমিকদের একাংশ।

২০১৮ সালে নির্ধারিত কাঠামো অনুযায়ী বর্তমানে একজন পোশাক শ্রমিকের ন্যূনতম মাসিক মজুরি আট হাজার টাকা। দেশের মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠনের দাবি ছিল ন্যূনতম নতুন মজুরি ২৩ হাজার টাকা। তবে মঙ্গলবার সরকার তা নির্ধারণ করেছে ১২ হাজার ৫০০ টাকায়।

“প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশে” এই মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে বলে মজুরি বোর্ডের সভা শেষে মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের জানান শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান।

ডলারের হিসাবে নতুন মজুরি ১১৩ ডলারের সমান, ২০১৮ সালে নির্ধারিত মজুরি ছিল ৯৫ ডলারের সমান।

মজুরি ঘোষণার পর প্রতিমন্ত্রী শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে আগে ক্ষতির শিকার হবে শ্রমিকরা।”

সরকার ঘোষিত এই নতুন মজুরিকে প্রত্যাখ্যান করেছে শ্রমিক সংগঠনগুলোর বড়ো অংশ। ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে আগামী শুক্রবার বিক্ষোভ কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে কয়েকটি সংগঠন।

তবে ‘বাস্তব অবস্থা’ বিবেচনায় কিছু সংগঠন সরকারি নতুন মজুরি কাঠামোকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন।

গত দুই বছর ধরে বড়ো ধরনের মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করে আসছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুসারে, গত আগস্টে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল সাড়ে ১২ শতাংশের বেশি, যা গত এক যুগে প্রায় সর্বোচ্চ। আগস্টের চেয়ে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে বলে দেখা গেছে গত সোমবার প্রকাশিত তথ্যে।

বাস্তবতা বিবেচনায় ‘গ্রহণযোগ্য’

মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধি সিরাজুল ইসলাম রনি গত ২২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা ন্যূনতম মজুরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাবের তুলনায় সরকার ঘোষিত মজুরি অনেক কম হলেও ঘোষিত মজুরিকে তিনি ‘গ্রহণযোগ্য’ বলে মনে করছেন।

সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে। তাঁদের (শ্রমিকরা) যাতে চাকরি হারিয়ে বাড়ি চলে যেতে না হয়, সেটিও ভাবতে হবে।”

প্রসঙ্গত, তিনি বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি।

তবে বাংলাদেশে যেভাবে পণ্যমূল্য বাড়ছে তাতে সরকার ঘোষিত এই নতুন মজুরিতে “শ্রমিকদের পক্ষে জীবন-ধারণ কঠিন হয়ে যাবে,” বলে বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ অ্যাপারেল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি এবং ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাবেক মহাসচিব তৌহিদুর রহমান।

সরকার ঘোষিত মজুরিতে “সন্তুষ্ট নন” জানিয়ে গাজীপুরের যমুনা ডেনিমসের শ্রমিক খোকন মিয়া বেনারকে বলেন, “অন্তত ১৫ হাজার টাকা হলে যৌক্তিক হতো।”

BD-2.jpg
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ঢাকায় পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় পুলিশের পাহারা। ২ নভেম্বর ২০২৩। [এএফপি]

শ্রমিকদের প্রত্যাখ্যান

মজুরি ঘোষণার পর পরই এটিকে প্রহসনের মজুরি আখ্যা দিয়ে রাজধানীর তোপখানা রোডে বিক্ষোভ করেছে কয়েকটি সংগঠন। ১১টি শ্রমিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত জোটের সমন্বয়ক তাসলিমা আক্তার বলেন, “তারা শ্রমিকদের মানুষ মনে করে না। যদি মনে করত, তাহলে এই ধরনের প্রস্তাব করতে পারত না।”

তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করে বলেন, “বিভিন্ন শ্রমিক অঞ্চল থেকে শ্রমিক বিক্ষোভের খবর পাওয়া যাচ্ছে। শ্রমিকরা যদি মাঠে নামে…তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে।”

এই জোট এক বিবৃতিতে আগামী ১০ নভেম্বর ২৫ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে।

“এই মজুরি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। নতুন করে মজুরি নির্ধারণের দাবি জানাই,” বেনারকে বলেন সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার।

তিনি বলেন, “২০১৮ সালে যখন মজুরি ঘোষণা করা হয়, তখন ৯৫ ডলার ছিল। নতুন করে বাড়ার পর তা হচ্ছে ১১৩ ডলার। তাহলে ডলারের হিসাবে মজুরি তো তেমন বাড়েনি।”

এদিকে গাজীপুরের কোণাবাড়িতে কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে মঙ্গলবার বিক্ষোভ করেছেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা অন্তত দু’টি বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন।

শিল্পাঞ্চল পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গাজীপুর) মো. ইমরান আহম্মেদ বেনারকে বলেন, “ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে দু’টি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। তবে এটি শ্রমিকরা না অন্য কেউ করেছে; তা আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।”

কম মজুরি বাংলাদেশে

নতুন করে মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণার পরও নয়টি প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশে মজুরি কম। ডলারের হিসাবে বাংলাদেশে শ্রমিকদের নতুন ন্যূনতম মজুরি ১১৩ ডলার।

শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী সেই সময় চীনে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছিল ২৬২ ডলার, ভারতে ১২৮ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ১৩৭ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১৯৪ ডলার, মালয়েশিয়ায় ২৫০, ফিলিপাইনে ২৪৪, ভিয়েতনামে ১৬৮ এবং তুরস্কে ৩০৭ ডলার।

বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার এবং রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে এ খাত থেকে, যার পরিমাণ ছিল গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার।

গত দুই বছর ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের পক্ষ থেকে নতুন মজুরি বোর্ড গঠনের দাবি ওঠে। গত এপ্রিলে নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। ছয় মাস পার হওয়ার পরে গত ২২ অক্টোবর মালিকপক্ষ ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব করলে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শ্রমিকরা।

পর দিন ২৩ হাজার টাকা মজুরির দাবিতে গাজীপুরে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন। এরপর ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় শ্রমিক অসন্তোষ বাড়তে থাকে। গত ৩০ অক্টোবর গাজীপুরে দুই শ্রমিক নিহত হন।

এদিকে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল আগামী সপ্তাহে বাংলাদেশে আসছে বলে বার্তা সংস্থা ইউএনবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ওই প্রতিনিধি দল বাংলাদেশের শ্রম অগ্রগতির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার পথনকশা অনুযায়ী অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে বলে জানায় ইউএনবি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।