নতুন মজুরি ঘোষণার পরদিন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ গেল নারী শ্রমিকের
2023.11.08
ঢাকা
তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা ঘোষণা করা হলেও অসন্তোষ দূর হয়নি। প্রত্যাশা অনুযায়ী মজুরি দাবি করে শ্রমিকরা রাস্তায় নামলে বুধবার গাজীপুরের কোণাবাড়ি এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন এক নারী পোশাক শ্রমিক।
নিহত মোসা. আঞ্জুয়ারা খাতুন (২৪) দুই সন্তানের জননী, কোণাবাড়ির ইসলাম গার্মেন্টসে সুইং অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন।
তিনি কীভাবে মারা গেছেন তা নিশ্চিত করেনি পুলিশ। তবে নিহতের স্বামী মো. জামাল বেনারকে জানান, তাঁর স্ত্রীর মাথায় আঘাতের চিহ্ন আছে। রাবার বুলেট বা টিয়ার গ্যাসের শেল লেগেছে। আহত হওয়ার পর আঞ্জুয়ারাকে প্রথমে কোণাবাড়ি একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠালে ডাক্তার তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
কোণাবাড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে.এম. আশরাফ উদ্দিন বুধবার বেনারকে বলেন, “ওই নারীশ্রমিক কীভাবে প্রাণ হারালেন সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। শ্রমিকরা যখন ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় তখন হুড়াহুড়ির মধ্যে সম্ভবত আহত হয়েছিলেন তিনি। আমরা লাইভ বুলেট ব্যবহার করিনি।”
“শ্রমিকরা পুলিশের দিকে বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে আমরা টিয়ার সেল, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করি। অল্প কিছু রাবার বুলেটও নিক্ষেপ করা হয়। শ্রমিকদের ইটের আঘাতে আমাদের চার জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন,” জানান ওসি।
এই প্রাণহানির ঘটনাকে কেন্দ্র করে গাজীপুরের শিল্পাঞ্চল এলাকায় শ্রমিকরা থেমে থেমে বুধবার বিকেল পর্যন্ত বিক্ষোভ চালিয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ওই এলাকায় আধা-সামরিক বাহিনী বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল পুলিশের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বেনারকে জানান, সন্ধ্যার দিকে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।
‘সরকার আমাদের বেঁচে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিক’
সংঘর্ষের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার ঘোষিত ন্যূনতম সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরি প্রদানের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেন শ্রমিকরা এবং ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে সকাল থেকেই গাজীপুরের কোণাবাড়ি, জরুনসহ সংলগ্ন এলাকায় রাস্তায় জড়ো হতে থাকেন।
ওসি কে.এম. আশরাফ উদ্দিন বলেন, কাজে না গিয়ে সকাল সাড়ে ৮টার দিকে হাজার হাজার শ্রমিক রাস্তায় জড়ো হতে থাকেন।
“তারা কারখানাগুলোতে ভাঙচুর শুরু করে এবং যারা কাজে যোগ দিতে যাচ্ছিল তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আমরা তাদের শান্ত করতে যাই। কারখানা ভাঙচুর বন্ধ করতে বললে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালায়,” বলেন আশরাফ।
তবে সহিংসতার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কোণাবাড়ি এলাকার শ্রমিক নাজমুল। তিনি বেনারকে বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছিলাম। পুলিশ আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করেছে। তারা সব সময়ই শ্রমিকদের হামলা করে।”
“পুলিশ টিয়ার গ্যাস না ছুড়লে, গুলি না চালালে কোনো কিছুই হতো না। আমাদের বোনটি মারা যেত না,” যোগ করেন নাজমুল।
তিনি আরও বলেন, “আমরা কেন রাস্তায় নামব? সংসার চলে না। সংসার চালানোর টাকা চেয়ে মরতে হচ্ছে আমাদের। আমরা চাই সরকার আমাদের বেঁচে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দিক। আমাদের রাস্তায় আসার কোনো দরকার নেই।”
৪৫ কারখানা বন্ধ
মঙ্গলবার সরকারের পক্ষ থেকে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের জন্য ওয়েজ বোর্ড ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা অনুযায়ী, একজন শ্রমিক সর্বনিম্ন মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা পাবেন, বর্তমানে যা আট হাজার টাকা।
তৈরি পোশাক কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এর মিডিয়া শাখার প্রধান শোভন ইসলাম শাওন বেনারকে বলেন, “একজন নারী পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। আমরা শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। সমস্যা সমাধানে সাময়িক সময়ের জন্য আগামীকাল থেকে প্রায় ৪৫টি কারখানা বন্ধ রাখা হবে। এটি শ্রমিক আইনের আওতায় ‘নো ওয়ার্ক-নো পে’ ভিত্তিতে করা হবে।”
শোভন বলেন, “আমরা মনে করি, যে মজুরি ঘোষণা করা হয়েছে সেটি বর্তমান মজুরির চেয়ে প্রায় শতকরা ৬০ শতাংশ বেশি। সাড়ে ১২ হাজার টাকার পর ওভার টাইমের টাকা যোগ হলে মাসে একেকজন শ্রমিক প্রায় ১৬ হাজার টাকা এবং একটু দক্ষ শ্রমিক ২০ হাজার টাকা মাসে আয় করতে পারবেন।”
তিনি বলেন, “অধিকাংশ শ্রমিকরা এই মজুরি কাঠামোতে খুশি। তবে কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে সমস্যা করার চেষ্টা করছে। আমরা চাই বিষয়টি যেন আর বড়ো না হয়। এর বেশি মজুরি বৃদ্ধি করা হলে আমাদের কম্পিটিটিভনেস থাকবে না। তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ”
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক রপ্তানির অবদান সবচেয়ে বেশি। দেশের মোট রপ্তানি পণ্যের মধ্যে শতকরা প্রায় ৮৫ শতাংশ তৈরি পোশাক। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয় হয়েছে প্রায় ৫৬ বিলিয়ন ডলার। এই শিল্পে কর্মরত প্রায় ৪০ লাখ কর্মীর মধ্যে শতকরা ৬০ শতাংশই নারী।
ন্যাশনাল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন এবং ইন্ডাস্ট্রিঅল এর প্রেসিডেন্ট আমিরুল ইসলাম আমিন বুধবার বেনারকে বলেন, “আমরা ২৩ হাজার টাকা চেয়েছি। আলোচনার মাধ্যমে আরেকটু মজুরি বৃদ্ধি করলেই আমাদের শ্রমিকরা খেয়ে বাঁচতে পারে। সেটি ১৫ হাজার টাকাও হতে পারে।”
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৈরি পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে খুবই সহানুভূতিশীল। আমরা তাঁর হস্তক্ষেপ কামনা করি।”
আমিরুল আরও যোগ করেন, “আমরা যখনই মজুরি বৃদ্ধির কথা বলি, তখনই মালিকদের পক্ষ থেকে জানানো হয় ক্রেতারা দাম বৃদ্ধি করেন না—কথাটা একদম ভুল নয়। তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য স্বল্প মূল্যে রেশনের ব্যবস্থা করলে সেটি সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে।”
দমন-পীড়নে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ
বাংলাদেশে নূন্যতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নেয়া শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং কারখানায় নিয়োজিত কর্মী ও তাঁদের ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
বুধবার পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, গত সপ্তাহে ২৬ বছর বয়সের সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের ইউনিয়ন নেতা রাসেল হাওলাদার পুলিশের হাতে নিহত হওয়ায় আমরা দুঃখিত। এ ছাড়া, ঢাকায় একটি কারখানায় বিক্ষোভকারীদের দেয়া আগুনে ইমরান হোসেনের (৩২) প্রাণহানির ঘটনায় শোক প্রকাশ করছি।
মিলার বলেন, শ্রমিক ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের দমন-পীড়নের বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচী পালনের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
মুখপাত্র আরও বলেন যেসব কারখানার মালিক ট্রেড ইউনিয়নের প্রস্তাব অনুযায়ী যুক্তিপূর্ণভাবে মজুরি বৃদ্ধি করেছে তাদের প্রশংসা করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।