মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে যুক্ত পোশাক শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করার অভিযোগ
2023.11.17
ঢাকা
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করা পোশাক শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন শ্রমিক নেতারা। শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত না করার আহ্বান জানিয়েছে জেনেভাভিত্তিক প্রভাবশালী সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন।
তবে শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে না বলে দাবি করেছে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)।
বিজিএমইএ-এর পক্ষ থেকে পোশাক কারখানা মালিকদের কাছে অগ্নি সংযোগ, ভাঙচুর ও মারামারির সব ঘটনার ছবি ও ভিডিও ফুটেজ চেয়ে পাঠানো একটি চিঠির কপি বেনারের হাতে এসেছে।
গত ৯ নভেম্বর পাঠানো ওই চিঠিতে কারখানাগুলোতে সব ধরনের নতুন নিয়োগ বন্ধ রাখারও নির্দেশনা দেয় বিজিএমইএ।
এই ঘটনাকে “আন্দোলনে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া,” বলে শুক্রবার বেনারের কাছে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিঅল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার।
তিনি বলেন, “আন্দোলনে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকলে কারখানা মালিক সেই তথ্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দেবে, বিজিএমইএ নেবে কেন?”
বিজিএমইএ’র অনলাইন তথ্যভাণ্ডারে শ্রমিকদের আঙুলের ছাপ সংরক্ষিত আছে, এবং সব কারখানা মালিকের সেখানে প্রবেশাধিকার রয়েছে বলে জানান তিনি।
কোনো শ্রমিক চাকরিচ্যুত হলে সেই তথ্যভাণ্ডারে এর কারণসহ তথ্য উল্লেখ থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, “কালো তালিকাভুক্ত কোনো শ্রমিকের এক কারখানা থেকে চাকরি চলে গেলে অন্য কারখানায় নিয়োগ দেওয়া হয় না।”
“শ্রম আইন অধিকার দিয়েছে—শ্রমিক তার বেতন নিয়ে কথা বলতে পারবে। সেই শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার।
শ্রমিকদের তথ্যভাণ্ডার “অপব্যবহার করে” মালিকপক্ষ “শ্রমিকের মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে,” মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কালো তালিকাভুক্ত করে শ্রমিকের মুখ বন্ধ করার যত চেষ্টা করা হবে, অসন্তোষ আরও তত বাড়বে।”
‘কালো তালিকাভুক্তি নতুন নয়’
এদিকে শ্রমিক নেতাদের অভিযোগ অস্বীকার করে বিজিএমইএ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বেনারকে বলেন, “শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে না।”
তিনি বলেন, “যে কারখানায় ভাঙচুর করবে, সে শাস্তি পাবে—এটাই স্বাভাবিক। তবে এটি প্রশাসনের কাজ। যারা ক্ষতিসাধন করেনি, তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই।”
ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, “আমরা দেখেছি, ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িতদের বেশির ভাগই শ্রমিক নন, বাইরের লোকজন।”
কারখানায় নতুন নিয়োগ বন্ধ রাখার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “একটি কারখানায় ভাঙচুর করে অন্য আরেকটি কারখানায় নিয়োগ নেয়, এটি ঠেকানোর জন্য এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
আন্দোলনের পর শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারটি নতুন নয় বলে জানান গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভানেত্রী তাসলিমা আখতার এবং গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি জলি তালুকদার।
তাসলিমা বলেন, “অতীতেও শ্রমিক ছাঁটাই করা হলে তাদের নাম ও ছবি অন্যান্য কারখানা মালিকদের কাছে পাঠানো হতো, যাতে তারা কোনো কারখানায় কাজ না পায়।”
কালো তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে গত বুধবার শ্রমিক সংগঠনগুলোর জোট ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের (আইবিসি) সংবাদ সম্মেলনে বাবুল আক্তার বলেন, “কোনো কারখানা যদি শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত করে, তাহলে আমরাও বায়ারদের বলব ওই কারখানাকে কালো তালিকাভুক্ত করতে।”
তবে কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো আপত্তি নেই বলে বেনারকে জানান তিনি।
শ্রমিক সংগঠনগুলো জানিয়েছে, ইতোমধ্যে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ১১৬টি মামলা হয়েছে, যাতে আসামি ২৩ হাজার, যাদের বেশিরভাগই অজ্ঞাতনামা। আশুলিয়া ও গাজীপুরে আন্দোলনে অংশ নেওয়া স্থানীয় শ্রমিক নেতাদেরও আসামি করা হয়েছে এবং গাজীপুর থেকে গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
“শ্রমিকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে,” বেনারকে বলেন বাংলাদেশ অ্যাপারেল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের গাজীপুরের অঞ্চলের সভাপতি নজরুল ইসলাম।
মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা গত ২৩ অক্টোবর থেকে আন্দোলন শুরু করেন। গত ৭ নভেম্বর সরকার এই খাতের শ্রমিকদের মজুরি আট হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা করার ঘোষণা দেয়। এই মজুরি প্রত্যাখ্যান করে শ্রমিকদের একটি অংশ রাস্তায় নামে এবং ন্যূনতম মজুরি ২৩ হাজার টাকা করার দাবি জানায়।
আন্দোলনের এক পর্যায়ে সহিংসতায় দুই শ্রমিকসহ মোট চার জন নিহত হন। শ্রমিকদের অভিযোগ, তিন জনই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন।
এর মধ্যে বেশ কিছু কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে এবং সব কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে।
কালো তালিকাভুক্তি বন্ধ করুন: ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন
শ্রমিকদের কালো তালিকাভুক্ত না করার আহ্বান জানিয়েছে জেনেভাভিত্তিক প্রভাবশালী সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল ইউনিয়ন।
স্থানীয় সময় বুধবার এক বিবৃতিতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এ পর্যন্ত ১০০ শ্রমিকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের ও তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শ্রমিক ও নেতাদের ক্রমাগত হয়রানি ও কালো তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে।
“কালো তালিকাভুক্ত করা দ্রুত বন্ধ করতে হবে এবং গ্রেপ্তার শ্রমিকদের মুক্তি দিতে হবে,” বলা হয় ওই বিবৃতিতে।
চার শ্রমিক নিহত হওয়ার ঘটনার সঠিক তদন্ত, প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, নিহতদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া, আহতদের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা ও কারখানা খুলে দেওয়ার আহ্বান জানায় এই জোট।
এছাড়া পোশাক খাতে মজুরি বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও চাওয়া হয় বিবৃতিতে।
নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের
বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকার রক্ষায় গত ১৬ নভেম্বর নতুন একটি মেমোরেন্ডামের কার্যক্রম শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
ওই মেমোরেন্ডাম সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেন, “শ্রমিক নেতা-সংগঠনকে ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া বা হামলা করা হলে জবাবদিহিতায় আনতে নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যিক জরিমানা ও ভিসা কঠোরতার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি বাংলাদেশের শ্রমিক নেতা কল্পনা আক্তারের নাম উল্লেখ করে বলেন, “আমরা বাংলাদেশি পোশাক শ্রমিক অধিকারকর্মী কল্পনা আক্তারের মতো মানুষদের জন্য সেখানে থাকতে চাই; যিনি বলেছেন—মার্কিন দূতাবাস তাঁর পক্ষে কথা বলায় তিনি আজ বেঁচে আছেন।”
ব্লিনকেন বলেন, “বলপ্রয়োগে শ্রম দিয়ে তৈরি পণ্য আমদানি করছি না তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেব। এটি কেবল আমাদের স্থানীয় বিষয় নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তা ও বৈদেশিক নীতির অংশ।”
যোগাযোগ করা হলে কল্পনা আক্তার বেনারকে বলেন, “শ্রমিকের অধিকারের পক্ষে যারা কাজ করবে তাদের আমরা সাধুবাদ জানাই। শ্রমিকদের জন্য এ রকম শক্ত ভূমিকা আমাদের সরকারের থাকা উচিত। কিন্তু অন্য সরকারের কাছ থেকে তা শুনতে হচ্ছে।”
বাংলাদেশে শ্রম অধিকার ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে না বা ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে না মন্তব্য করে বিজিএমইএ সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, “এতে আমাদের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই।”