তাজরীন ফ্যাশনস দুর্ঘটনা: সাক্ষীর অভাবে বিচার শেষ হয়নি আট বছরেও

শরীফ খিয়াম
2020.11.23
ঢাকা
201123_Tazrin-Bangla_1000.jpg ক্ষতিপুরণের দাবিতে গত সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করছেন তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকরা, তাঁদেরই দুইজন। ৩ নভেম্বর ২০২০।
[বেনারনিউজ]

তৈরি পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিক নিহত হওয়ার আট বছরেও সেই ঘটনার বিচার শেষ হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা ‘অবহেলাজনিত কারণে’ মৃত্যুর মামলাটি সাক্ষীর অভাবে থমকে আছে।

আলোচিত এই দুর্ঘটনা শুরু থেকে পর্যবেক্ষণকারী নৃবিজ্ঞানী সাইদিয়া গুলরুখ কামাল বেনারকে জানান, ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২০১৫ সালের ১ অক্টোবর সাক্ষ্যগ্রহণের কাজ শুরু হয়। এ জন্য গত ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৩৮ বার তারিখ ধার্য করেছেন বিচারক।

“৩৮ দিনের মধ্যে মাত্র ছয়দিন আদালতে সাক্ষী হাজির করতে পেরেছে রাষ্ট্রপক্ষ,” সোমবার বলেন এই গবেষক।

এদিকে মামলার ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র আটজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন জানিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ দাবি করেছে, বাকিদের পাওয়া যাচ্ছে না।

ঢাকা জেলা ও দায়রা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) খন্দকার আব্দুল মান্নান বেনারকে বলেন, “বেশিরভাগ সাক্ষীই আগে যে ঠিকানায় ছিল, এখন আর সেখানে নেই। শহরে থাকার কারণে গ্রামের স্থায়ী ঠিকানায় সমন পাঠালেও তাঁরা পান না। যে কারণে এই অবস্থা দাঁড়িয়েছে।”

সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ‘প্রসিকিউসন টিম’ আরো তৎপর হয়ে সাক্ষীদের হাজির করার চেষ্টা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “২০২১ সালের মধ্যে মামলাটি নিষ্পত্তি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী তারিখ (১৩ জানুয়ারি) থেকে মামলা যাতে সুষ্ঠুভাবে চলে, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।”

অন্যদিকে সাক্ষী না পাওয়া গেলে মামলা খারিজের বিধান থাকার কথা উল্লেখ করে বিবাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহমেদ বেনারকে বলেন, “আমরা আদালতের কাছে মামলা খারিজের আবেদন করব। কারণ ইতিমধ্যে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। অথচ রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের আনতেই পারছে না।”

“তা ছাড়া এটা এখন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আসল কোনো সাক্ষী ছিলই না। জোর করে যাদের সাক্ষী বানানো হয়েছে তারা আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দিতে আসতে চাইছে না। ইতিপূর্বে যারা সাক্ষী দিয়েছে, তারাও বলছে এটা দুর্ঘটনা। অর্থাৎ বিবাদীদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার সত্যতা নেই,” বলেন তিনি।

প্রসঙ্গত, মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, তাজরীন গার্মেন্টস ভবনের নকশায় ত্রুটি ছিল। জরুরি নির্গমনের পথ ছিল না। আগুন লাগার পর শ্রমিকেরা বাইরে বের হতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা অগ্নিকাণ্ডকে অগ্নিনির্বাপন মহড়া বলে তাঁদের কাজে ফেরত পাঠিয়ে ‘কলাপসিবল গেট’ বন্ধ করে দেন বলেও উল্লেখ রয়েছে সেখানে।

পিপি মান্নান বলেন, “মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। আমরা (রাষ্ট্রপক্ষ) চাই, সারা বাংলাদেশ জানুক, ভয়াবহ এ ঘটনায় সত্যিকারের একটা বিচার হয়েছে।”

অন্যদিকে এই মামলার কারণে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিকের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাঁর সবগুলো ব্যবসা স্থবির হয়ে আছে উল্লেখ করে বাদীপক্ষের আইনজীবী ফারুক বলেন, “মূলত এ কারণে আমরাও চাই মামলাটি দ্রুত নিস্পত্তি হয়ে যাক।”

আট বছর পূর্তি উদযাপন

তাজরীন ট্র্যাজেডির আট বছর পূর্তি উপলক্ষে মঙ্গলবার বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংগঠনগুলো।

ওই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত যেসব শ্রমিক ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করছেন, তাঁরাই মঙ্গলবার কাফনের কাপড় পড়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রার ঘোষণা দিয়েছেন।

“জিন্দা লাশের মিছিল বের করব আমরা। কারণ কিছু আর্থিক অনুদান ছাড়া আজও কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ পাইনি। অন্যদিকে অভিযুক্ত মালিকের বিচারের তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। সাক্ষ্য গ্রহণের নামে টালবাহনা করা হচ্ছে,” বেনারকে বলেন ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের নেত্রী জরিনা বেগম।

গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা বন্ধ ও শ্রমিক হত্যায় দোষীদের বিচার ও শাস্তির পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ আইন বদল এবং সব কারখানায় নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে এবারের তাজরিন দিবস পালন করবেন তাঁরা।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের নেতা মঞ্জুর মঈন বেনারকে জানান, প্রায় সবগুলো গার্মেন্ট শ্রমিক সংগঠনই দিনটিকে স্মরণ করবে। তাজরিন কারখানার গেট ও জুরাইন কবরস্থানে নানা কর্মসূচি পালন করা হবে।

ঢাকার অদূরে সাভারের আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তোবা গ্রুপের মালিকানাধীন ওই প্রতিষ্ঠানটিতে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতের অগ্নিকাণ্ডে সরকারি হিসেবে ১১২ জন এবং বেসরকারি হিসেবে ১১৯ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া দুই শতাধিক শ্রমিক আহত ও দগ্ধ হন।

পরদিন আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক এসআই খায়রুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। সেই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ যুক্ত করা হয়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) দেলোয়ার হোসেনসসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

প্রায় দুই বছর পর ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান।

একই বছর ১ অক্টোবর থেকে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এর আগে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দেলোয়ারকে কারাগারে পাঠানো হলেও ছয় মাস পর জামিনে মুক্তি পান তিনি।

অন্য অভিযুক্তদের মধ্যে দেলোয়াররের স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার ছাড়াও রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির দুর্ঘটনাকালীন দায়িত্বরত ১১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী।

এর মধ্যে দুর্ঘটনাকালীন সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন পলাতক। অন্যরা জামিনে আছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।