এক যুগ জেলে থাকা সোহেল রানা জামিন পেলেও আটকে দিলেন চেম্বার জজ

জেসমিন পাপড়ি
2024.10.02
ঢাকা
এক যুগ জেলে থাকা সোহেল রানা জামিন পেলেও আটকে দিলেন চেম্বার জজ ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসের তিন দিন পর ওই ঘটনায় নিহত ও নিখোঁজদের ছবি দেখাচ্ছেন তাঁদের স্বজনরা। ২৭ এপ্রিল ২০১৩।
[এএফপি]

এক দশক আগে সাভারের রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক পোশাক শ্রমিক নিহত হওয়ার মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাকে হাইকোর্ট জামিন দিলেও বুধবার তা স্থগিত করেছে চেম্বার আদালত।

গত মঙ্গলবার হাইকোর্ট ওই জামিন দেওয়ার পর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় পোশাক শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন।

সোহেল রানা প্রায় এক যুগ ধরে জেলে রয়েছেন, এর মধ্যে বেশ কয়েকবার জামিনের চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার জামিন মিললেও পোশাক শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনসহ ট্রেড ইউনিয়নগুলোর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে সেই জামিন আটকে যায়।

এর আগে ২০২৩ সালের ৬ এপ্রিল হত্যা মামলায় হাইকোর্ট সোহেল রানাকে জামিন দিলেও আপিল বিভাগ তা স্থগিত করে। তবে বিনা বিচারে এত বছর একজনকে জেলে রাখা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সোহেল রানার আইনজীবী সাজ্জাতুল হায়দার চৌধুরী।

“এই ভদ্রলোক (সোহেল রানা) ২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে টানা প্রায় ১২ বছর ধরে জেলে আছেন। দীর্ঘসূত্রতার কারণে তার মামলাগুলোর এখনো বিচারাধীন,” বলেন তিনি।

সাজ্জাতুল হায়দার বলেন, “ওনার (সোহেল রানা) নামে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর সাতটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে ইমারত নির্মাণ আইনে করা মামলা, অস্ত্র আইনের মামলা ও মাদক মামলায় তিনি জামিন পান। বাকি তিনটি মামলা দুদকের করা, যার একটিতে সোহেল রানার সাজা হয় এবং সেই সাজা তিনি খেটে ফেলেছেন। বাকি দুটি মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন।”

আইনজীবী জানান, শুধু রানা প্লাজা ধসে হতাহতের মামলায় জামিন পাওয়া বাকি ছিল তাঁর। এ বছরের ১৫ জানুয়ারি দেওয়া রায়ে আপিল বিভাগ বলেছে, ছয় মাসের মধ্যে বিচারিক আদালতকে এই মামলার বিচার শেষ করতে। অন্যথায় সোহেল রানা যদি জামিন আবেদন করেন সেটি যেন বিবেচনা করা হয়।

“এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই সেপ্টেম্বরে তিনি আবার জামিন আবেদন করেন। শুনানির পর আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণের আলোকে হাইকোর্ট জামিন দেন। কিন্তু আবার সরকার পক্ষের আবেদনের পর জামিন স্থগিত করে ২১ অক্টোবর মামলাটি শুনানির জন্য রেখেছেন চেম্বার জজ,” জানান আইনজীবী সাজ্জাতুল হায়দার।

এক প্রশ্নের জবাবে সোহেল রানার এই আইনজীবী বলেন, “বিচার শেষ না হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো প্রতিটি মামলায় অনেক সাক্ষী রাখা।

তিনি বলেন, “রানা প্লাজা ধসে হতাহতের মামলায় চার্জশিটে প্রায় ৫৯৬ জন সাক্ষীর কথা বলা আছে। এত বছরে এখন পর্যন্ত ৯১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। ফলে এ মামলার বিচারকাজ কবে শেষ হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।”

শ্রম অধিকার বিষয়ক আইনজীবী জাফরুল হাসান শরীফ বেনারকে বলেন, দীর্ঘসূত্রতার বড়ো কারণ, আমাদের দেশে মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা অনেক কম। আমাদের সুশাসন ব্যবস্থা যদি উন্নত হয় তাহলে মামলার সংখ্যা কমে যাবে।”

“কিন্তু সুশাসনের ঘাটতি থাকায় কোর্টে মামলা বাড়ছে। ফলে জনগুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকছে। এতে করে বিচারাধীন ব্যক্তির মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

এদিকে নতুন সরকাররে কাছে হাজারো শ্রমিক হত্যার দায়ে অভিযুক্ত সোহেল রানার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতে পুনরায় তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন।

বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার এবং সাধারণ সম্পাদক বাবুল হোসেন বুধবার এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, গত ৫ আগস্ট অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সোহেল রানার বিচার ত্বরান্বিত না করে তাকে জামিনে ছেড়ে দিলে এটি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হবে।”

“হাজারো শ্রমিককে কাঠামোগত হত্যার জন্য অভিযুক্ত সোহেল রানাসহ অভিযুক্তরা যদি মুক্ত হয় তাহলে ইতিহাসে নিকৃষ্টতম ঘটনার স্বাক্ষর তৈরি হবে,” বলেন তারা।

8821605b-73a8-4f54-884f-3349585a44b4.jpeg
সাভারে রানা প্লাজা ধসে সহস্রাধিক শ্রমিক নিহতের ঘটনায় ভবনের মালিক সোহেল রানাকে (মাঝখানে) গ্রেপ্তারের পর র‍্যাব সদর দপ্তরে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে হাজির করা হয়। ২৮ এপ্রিল ২০১৩। [বেনারনিউজ]

২১ অক্টোবর পরবর্তী শুনানি

বুধবার রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে প্রেক্ষিতে এই স্থগিতাদেশ দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হক। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনিক আর হক।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সোহেল রানাকে দেওয়া হাইকোর্টের জামিন স্থগিত করেছেন চেম্বার আদালত। আর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে ২১ অক্টোবর শুনানির জন্য রেখেছেন। সে পর্যন্ত হাইকোর্টের জামিন আদেশটি স্থগিত থাকবে।”

এর আগের দিন মঙ্গলবার বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খান ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ সোহেল রানাকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তী জামিন দেন।

সেই সঙ্গে সোহেল রানার নিয়মিত জামিন প্রশ্নে রুল জারি করেন উচ্চ আদালত। কেন তাঁকে নিয়মিত জামিন দেওয়া হবে না, জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন আটতলা রানা প্লাজা ভেঙে নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন তৈরি পোশাক কর্মী। শিল্পক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় আহত হন আরও হাজারখানেক শ্রমিক।

সেসময় বাংলাদেশের কারখানার অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশের বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ও মালিকরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। এতে পোশাক শিল্পের কর্মপরিবেশ অনেকটাই উন্নত হয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।