ধর্মের সাথে ফ্যাশন, বাংলাদেশে বাড়ছে হিজাব পরার প্রবণতা
2024.03.22
ঢাকা
ঢাকা নিউ মার্কেটের তিন নম্বর ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই বাম দিকে পথের ওপরে প্রথম দোকানের মালিক মোহাম্মদ হৃদয়। রঙ-বেরঙয়ের হিজাবের পসরা সাজিয়েছেন। দিনে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি হয়, তবে হিজাবের এই বিক্রিটা বছর কয়েক আগেও ছিল না বলে বেনারকে জানান তিনি।
“আমার দোকানে এক সময় ওড়নার রমরমা ব্যবসা ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে দেশে হিজাবের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসার ধরন বদলে ফেলি,” বলেন হৃদয়।
বাংলাদেশে নব্বই দশকের আগে পর্যন্ত হিজাব পরার প্রচলন কম থাকলেও বর্তমানে স্কুল-কলেজ, থেকে শুরু করে হাট-বাজার, অফিস-আদালত; সব জায়গায় হিজাব পরা নারীদের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো।
নারীদের মতে, কেউ ধর্মীয় কারণে, কেউ নিরাপত্তার কারণে আবার কেউ কেউ ফ্যাশনের জন্যও হিজাব পরেন।
“আমি আগে হিজাব পরতাম না। কিন্তু বাবার মৃত্যু আমাকে পরলোক নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে। এরপর থেকে নিজেই হিজাব বেছে নিয়েছি, যাতে একজন মুসলমান হিসেবে উপযুক্ত পর্দা করতে পারি,” ঢাকার কারওয়ান বাজার মেট্রোরেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে বেনারকে বলেন চাকরিজীবী নারী এরিনা সিদ্দিকা (২৬)।
একটি রাজনৈতিক দলের তরুণ নেতা জান্নাতুন নওরীন উর্মী বেনারকে জানান, তিনি হিজাব পরেন নিরাপত্তাজনিত কারণে।
“আমি যে খুব ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে হিজাব পরি তা নয়। পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হিজাব ছাড়াও যাই। কিন্তু রাজনীতি করার কারণে আমাকে দলের মিছিল-মিটিংয়ে যেতে হয়, সেসব ভিড়ে হিজাব পরা থাকলে নিরাপদ বোধ করি। আমার ধারণা, হিজাব পরা মেয়েরা কিছুটা হলেও যৌন নিপীড়ন থেকে রেহাই পায়,” বলেন উর্মী।
হিজাবকে মুসলিম নারীদের পর্দার একটি অনুষঙ্গ ধরা হলেও বাংলাদেশে হিজাব পরায় রাষ্ট্রীয় কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে বিষয়টি নিয়ে মাঝে মাঝে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা তৈরি হয়।
সর্বশেষ হিজাব না পরায় মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলায় একটি স্কুলের এক নারী শিক্ষক গত ২৯ ফেব্রুয়ারি সপ্তম শ্রেণির নয় জন ছাত্রীর চুল কেটে দেন। এ নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। ব্যবস্থা নেওয়া হয় ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
হিজাব ও ফ্যাশন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য মুবিনা খন্দকার পরিচালিত এক গবেষণাপত্র অনুসারে, বাংলাদেশে সত্তরের দশকে হিজাবের ব্যবহার বিরল থাকলেও “নব্বইয়ের দশকে ধীরে ধীরে এ দেশের নারীরা হিজাবে অভ্যস্ত হতে শুরু করেন এবং গত এক দশকে এটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।”
নারীদের মধ্যে হিজাবের জনপ্রিয়তার পেছনে অন্যান্য কারণের সাথে বিশ্বায়নের প্রভাবও উল্লেখযোগ্য বলে উল্লেখ করা হয় ২০২১ সালে প্রকাশিত “মুসলিম পোশাক হিসেবে হিজাব এবং বাংলাদেশের একটি ফ্যাশন ট্রেন্ড” শীর্ষক ওই গবেষণাপত্রে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন বয়সের নারীরা ফ্যাশনের অনুষঙ্গ হিসেবেও হিজাব পরছেন বলে উল্লেখ করা হয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষার্থী মোশরেফা শরীফ পরিচালিত ‘বাংলাদেশি শহুরে তরুণীদের মধ্যে ‘হিজাব’ পরার পেছনের কারণ’ শীর্ষক ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে।
এতে বলা হয় “এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ফ্যাশন এবং ধর্ম যে একসঙ্গে চলতে পারে না—সেই ধারণা থেকে তাঁরা বেরিয়ে এসেছেন।” তবে বাংলাদেশি নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি “ভেবে দেখার মতো।”
হিজাব ব্যবহারকারী নারীরা “বাঙালি পরিচয়ের চেয়ে মুসলিম নারী হিসেবে পরিচিত হতে বেশি আগ্রহী, যা বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর নারী ও মেয়েদের মধ্যে পার্থক্য আনতে পারে এবং সমাজের সংস্কৃতিতে প্রভাব ফেলতে পারে,” বলা হয় ওই গবেষণাপত্রে।
“হিজাব আমার কাছে নিয়মিত ফ্যাশনের একটি অংশ। আমার মনে হয়, হিজাব পরলে আমাকে বেশি সুন্দর লাগে, আর পরিবারও খুশি হয়। ওয়েস্টার্ন পোশাক থেকে শুরু করে বাঙালির শাড়ি—যে কোনো পোশাকের সঙ্গেই হিজাব মানিয়ে যায়,” বেনারকে বলেন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইশিতা আরবী।
পোশাকের মতো হিজাবেরও নানান ধরনের ডিজাইন রয়েছে বলে বেনারকে জানান ঢাকা নিউ মার্কেটের তরুণ হিজাব বিক্রেতা শাহদাত হোসেন বুলু।
তিনি বলেন, “এখনকার আধুনিক তরুণীদের ফ্যাশনেবল হিজাবই বেশি পছন্দ।”
ঢাকার নিউ মার্কেট, চকবাজার থেকে বসুন্ধরা সিটি বা যমুনা ফিউচার পার্কের মতো আধুনিক শপিংমলেও হিজাবের শো-রুম আছে৷ এ ধরনের কয়েকটি শো রুম ঘুরে দেখা যায়, ৫০০ থেকে শুরু করে চার হাজার টাকা দামের হিজাব রয়েছে।
এসব দোকানের পাশাপাশি অনলাইনেও হিজাবের ব্যবসা বেশ রমরমা।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বায়নের কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশের মুসলিমদের জীবনধারার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে, এরই অংশ হিসেবে ফ্যাশন বাজারে হিজাব গুরুত্ব পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ভোগ ম্যাগাজিনেও হিজাব পরা মডেলদের উপস্থিতি দেখা যায়।
তবে কারো কারো মতে, হিজাব নারীদের জন্য একটি প্রতিবন্ধকতা।
হিজাব: পর্দা বনাম বন্ধন
হিজাবকে একটি “আরোপিত পোশাক” হিসেবে আখ্যায়িত করে নারী অধিকার কর্মী খুশি কবীর বেনারকে বলেন, “এটি কখনো আমাদের দেশে ছিল না।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে মানুষ সব সময় ধার্মিক ছিল কিন্তু এত কট্টর কেউ ছিল না। এখন একটা গোষ্ঠী ধর্ম হিসেবে এই ধরনের পোশাক আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। তাঁরা নানাভাবে মানুষের ওপর প্রভাব খাটিয়ে বলছেন, এই ধরনের পোশাক মানেই ইসলাম।”
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার বিজয়ী কবি শামীম আজাদের মতে, হিজাব “সত্যিকার অর্থে একটা বন্ধন।”
তিনি বলেন, “আমাদের মা-খালাদের দেখেছি শালীনতার প্রশ্নটুকু একেবারেই নিজের কাছে। মাথায় কাপড় তুলে দেওয়া, ঘোমটা তুলে দেওয়া; এটা আমাদের সংস্কৃতিতে সব সময় ছিল। কিন্তু তাতে আবদ্ধতার ব্যাপারটি নেই।”
হিজাবকে বাঙালি “সংস্কৃতিবিরোধী” এবং “নারীর জন্য বাস্তব প্রতিবন্ধকতা” হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “বাঙালি মানুষের সাজ-পোশাক বাঙালিয়ানা হওয়া উচিত। কোনো আরব দেশের পোশাক আমাদের হতে পারে না। এটা আমাদের জলবায়ু, আবহাওয়া, আহার, বাসস্থানের সঙ্গে বন্ধু ভাবাপন্ন নয়।”
তবে কোরানিক দআওয়াহ একাডেমি মজলিস আয-যিকরের পরিচালক মাওলানা ওমর ফারুক ফেরদৌসের মতে, বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম মানার প্রবণতা বাড়ার পাশাপাশি ধার্মিক পরিবারের মেয়েদের শিক্ষাঙ্গনে আসার হারও বেড়েছে। এ কারণে হিজাব বেশি দেখা যায়।
“গ্রামগুলোতে কিন্তু পর্দা একই রকম আছে। বরং শিথিল হয়েছে অনেক জায়গায়,” বেনারকে বলেন ওমর ফারুক।
বর্তমান সময়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সংস্কৃতি ও মানুষ সম্পর্কে জানা সহজ হওয়ায় আরব দেশের সংস্কৃতিও সহজে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ধর্মীয় মিল থাকার কারণে তাঁদেরকে অনুসরণের বিষয়ও থাকতে পারে।”
তিনি বলেন, “যারা হিজাব পরে তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় ও সংস্কৃতির ব্যাপার যেমন আছে, তেমনি তারা ফ্যাশনের কারণেও পরেন।”
বাংলাদেশে এক সময় বোরকা পরা মানে “আপাদমস্তক ঢেকে রাখার ব্যাপার ছিল” এবং এদেশের আলেমরাও সেগুলোর কথা বলতেন জানিয়ে তিনি বলেন, “কিন্তু মানুষ এখন বাইরের ইসলামি স্কলারদের আলোচনা পড়তে বা শুনতে পারে। এর কারণে মানুষ আরও সহজ ধর্মাচার পালন শিখেছে। এক সময় যারা বোরকা পরতেন না, তাঁরাও এখন হিজাবের মাধ্যমে পর্দা করছেন।”
“এতে নারীর উন্নয়ন কোনোভাবে ব্যাহত হচ্ছে না। হিজাব পরলে তার স্বাভাবিক কাজ-কর্মে কোনো সমস্যা হচ্ছে না,” বলেন ওমর ফারুক।
এদিকে “শরিয়তের হুকুম নারীর পর্দা করা, সেটা মানতে হবে,” জানিয়ে বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুবাদ ও সংকলন বিভাগের সম্পাদক ড. মুশতাক আহমদ বেনারকে বলেন, “দেশে পর্দা করার প্রবণতা বাড়া আমাদের জন্য ইতিবাচক।”
কবি শামীম আজাদের মতে, বাংলাদেশে হিজাবের ব্যবহার বাড়ার পেছনে কারণ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন।