বিমান ছিনতাই চেষ্টা, কমান্ডো অভিযানে সন্দেহভাজন অস্ত্রধারী নিহত

জেসমিন পাপড়ি
2019.02.24
ঢাকা
190224-BD-hijack-620.jpg বাংলাদেশ বিমানের দুবাইগামী ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজটি ছিনতাই চেষ্টার কারণে চট্টগ্রামে জরুরি অবতরণের পর কমান্ডো অভিযানে সন্দেহভাজন অস্ত্রধারী নিহত হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।
[বেনারনিউজ]

বাংলাদেশ বিমানের দুবাইগামী উড়োজাহাজ ছিনতাই চেষ্টায় জড়িত এক অস্ত্রধারী আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছে। ওই বিমানের যাত্রী ও ক্রু সকলেই নিরাপদ রয়েছেন। মেহেদী নামের ওই সন্দেহভাজন বাংলাদেশের নাগরিক এবং বয়স আনুমানিক ৩০ বছর বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে প্রায় দুই ঘণ্টার নাটকীয়তার পর আত্মসমর্পণে রাজি না হওয়ায় আট মিনিটের অভিযানে ওই ছিনতাইকারী নিহত হয়।

চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল মতিউর রহমান এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “অস্ত্রধারীর সাথে একটি পিস্তল ছিল। সে বিমানের কেবিন ক্রুদের জিম্মি করে ফেলে।”

তিনি বলেন, “কৌশলের অংশ হিসেবে, অভিযান শুরুর আগে আমরা তাকে কথাবার্তায় ব্যস্ত রাখি। এরপর সে কেবিন ক্রুদের ছেড়ে দেয়। আমাদের কাছে সে দুটি দাবি জানায়, সে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে চায়। আমরা তাকে নিশ্চয়তা দেই যে, তার দাবি পূরণ করা হবে।”

“অভিযানের প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পর আমরা তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলি। কিন্তু সে তা করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর আমরা অভিযান শুরু করি,” বলেন জেনারেল মতিউর।

তিনি বলেন, “মাত্র আট মিনিটেই অভিযান শেষ হয়। বিমানের ভেতরেই তাকে কাবু করা হয়। সে বিমানের ভেতরে আহত হয় ও সেখান থেকে বের করে আনার পর বাইরে মারা যায়।”

পাইলটের কাছে ছিনতাইকারী নিজেকে মেহেদী হিসেবে পরিচয় দিয়েছে জানিয়ে জেনারেল মতিউর বলেন “প্রথমে পাইলট তাকে বিদেশি ভাবলেও সে মূলত একজন বাংলাদেশি।"

এদিকে “অস্ত্রধারী সম্ভবত মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল,” বলে ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাঈম হোসেন। তিনি বলেন, “তার সাথে আগ্নেয়াস্ত্র এবং শরীরে বিস্ফোরক বাঁধা ছিল।”

কমান্ডোদের অভিযান সন্ধ্যা ৭.১৮ মিনিটে শুরু হয়ে ৭.২৫ মিনিটে শেষ হয় জানিয়ে তিনি বলেন, “যাত্রী বা কেবিন ক্রুদের কেউ হতাহত হননি।”

১৪২ জন যাত্রী ও পাঁচজন ক্রু নিয়ে ‘ময়ূরপঙ্খী’ নামের বোয়িং-৭৩৭ মডেল বিমানের বিজি-১৪৭ ফ্লাইটটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাচ্ছিল। ছিনতাই চেষ্টার কবলে পড়ে বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে উড়োজাহাজটি চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করলে সকল যাত্রী ও ক্রু নিরাপদে বের হয়ে আসেন।

বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা এয়ার ভাইস মার্শাল মফিদুর রহমানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ সম্মিলিত অভিযান পরিচালনা করে।

এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, “যতটুকু জানা গেছে, একজন সন্দেহভাজন পাইলটের মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিল।”

ছিনতাইকারীর আনুমানিক বয়স ৩০ বলে বেনারকে জানান ওই ফ্লাইটের এক যাত্রী ওসমান গণি।

এদিকে উদ্ধার অভিযানের পর বিমানটি এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ ও যাত্রার জন্য প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন জেনারেল মতিউর।

“আমরা পুরো বিমান তল্লাশি করে দেখেছি, ওটা এখন যাত্রার জন্য প্রস্তুত। শাহ আমানত বিমানবন্দরের কার্যক্রম আবার চালু হয়েছে,” বলেন তিনি।

যাত্রীদের বর্ণনায় ছিনতাই চেষ্টা

বিকেল সাড়ে চারটার দিকে উড়োজাহাজটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাত্রা করে জানিয়ে ওই ফ্লাইটের এক যাত্রী ইভা বেনারকে বলেন, “হঠাৎ ফ্লাইটে গুলির শব্দ শুনি। তখন সবাই ছোটাছুটি শুরু করে। প্লেনটিও উঁচু-নিচু করছিল। যাত্রীরা সবাই কান্নাকাটি শুরু করে, দোয়া-দরুদ পড়ে।”

তিনি বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম, প্লেনে হয়তো আগুন লেগেছে। তখন দেখি, এয়ার হোস্টেজরাও যাত্রীদের সিটে সিটবেল্ট বেঁধে বসা। অনেকক্ষণ এমন পরিস্থিতি থাকার পর প্লেনটি ল্যান্ড করে।”

ইভা ছিনতাইকারীকে না দেখলেও আরেক যাত্রী ওমান প্রবাসী ওসমান গণি (৩৫) ছিনতাইকারীকে দেখেছেন জানিয়ে বেনারকে জানান, তার আনুমানিক বয়স ৩০ এবং “তার মুখে কোনো দাড়ি ছিল না।”

তিনি বলেন, “আমি ওমান থেকে ঢাকায় পৌঁছে চট্টগ্রামে যাবার জন্য ওই ফ্লাইট নিয়েছিলাম। বিমান ওড়ার ১৫ থেকে ১৭ মিনিটের মাথায় আমাদের বয়সী এক লোক হাতে ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে পেছন থেকে দৌড়ে এসে বলতে থাকে- কেউ সিট থেকে ওঠার চেষ্টা করবেন না, সবাই বসে থাকেন।”

“এরপর সে পাইলটের কাছে গিয়ে তাঁর পাশে বসে পড়ে। আমরা দুই-তিনটা গুলির শব্দ শুনি। এরপর বিমানটা এদিক ওদিক কাত হতে থাকে। আমরা ভয়ে আল্লার নাম নেওয়া শুরু করি,” বলেন ওসমান।

“সে খুব ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছিল। আমরা ককপিটে শুধু ধোয়া দেখতে পাচ্ছিলাম,” জানিয়ে ওসমান বলেন, “বিমান চট্টগ্রামে নামার সাথে সাথে আমি ইমার্জেন্সি অবতরণ দিয়ে লাফিয়ে বের হয়ে আসি। এর পর অন্য যাত্রীরাও একইভাবে বের হয়ে আসে।”

“সবাই ভয়ে ছিলাম। শুনেছি পাইলটকে আটকে রেখেছে। প্রথমে গেট দিয়ে নামতে পারি নাই। পরে প্লেনের পাশের জরুরি গেট দিয়ে আমাদের নিচে নামানো হয়,” বলেন ইভা।

বাংলাদেশ বিমান সূত্রে জানা যায়, ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজটির ১৬২ আসনের মধ্যে ইকোনমি ক্লাসে ১৩৩ জন ও বিজনেস ক্লাসে নয়জন যাত্রী ছিলেন। এ ছাড়া দুজন নারীসহ পাঁচজন ক্রু এবং ককপিটে দুজন পাইলট ছিলেন। উড়োজাহাজটি ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বহরে যুক্ত হয়।

বাংলাদেশে এটি দ্বিতীয় বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা। এর আগে ১৯৭৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের মুম্বাই থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি বিমান ছিনতাই করে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দরে নামতে বাধ্য করে জাপানের রেড আর্মির সদস্যরা।

জাপান এয়ারলাইনসের ডিসি ৮ বিমানটিতে ১৪ জন ক্রু ও ১৩৭ জন যাত্রী ছিলেন, এটি প্যারিস থেকে মুম্বাই হয়ে ব্যাংকক যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয় জাপান সরকার।

এদিকে বিমান ময়ূরপঙ্খী ছিনতাই চেষ্টার ঘটনা তদন্তে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জনেন্দ্র নাথ সরকারের নেতৃত্বে একটি তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।

ঢাকায় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বলয় পেরিয়ে অস্ত্র নিয়ে কীভাবে ওই দুর্বৃত্ত বিমানে উঠেছে এই প্রশ্নের জবাবে বেবিচক–এর চেয়ারম্যান নাঈম হাসান বলেছেন, “বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বলয় পেরিয়ে অস্ত্র নিয়ে ভেতরে যাওয়া সম্ভব না, তারপরও কীভাবে গেলো সেটি তদন্ত করার বিষয়। নিরাপত্তা নিয়ে কারও গাফিলতি ছিল কিনা সেটা খতিয়ে দেখা হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।