বান্দরবানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গুলিতে সেনা সদস্য নিহত

আহম্মদ ফয়েজ
2023.03.13
ঢাকা
বান্দরবানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের গুলিতে সেনা সদস্য নিহত বান্দরবান পাহাড়ি সড়কে মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন দুজন আরোহী। ৩ জানুয়ারি ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল বান্দরবানের রুয়াংছড়িতে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির অতর্কিত হামলায় এক সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরো দুই সেনা সদস্য।

সোমবার আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোববার আনুমানিক দুপুর একটার দিকে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে।

এ ঘটনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন এবং দুই জন সেনা সদস্য আহত হয়। আহত দুই সেনাসদস্য বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন, বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

আইএসপিআর জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে জাতীয় শিশু দিবস-২০২৩ ও মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় মা ও শিশুদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের কাজে থাকা দলের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনা সদস্যদের ওপর কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে।

“বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি নামক এই সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলটি ইতোপূর্বে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’র মত একটি জঙ্গি গোষ্ঠীকেও বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় অর্থের বিনিময়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছে,” বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।

৪ শ্রমিক জিম্মি

আইএসপিআর জানায়, পাহাড়ি এলাকার উন্নয়নের জন্য সরকার কর্তৃক নির্মিতব্য বান্দরবানের থানচি সড়ক সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এই উন্নয়নমূলক কার্যক্রমকে প্রতিহত করতে কেএনএ সন্ত্রাসী দলটি সড়ক নির্মাণ কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত অসামরিক ঠিকাদার, মালামাল সরবরাহকারী এবং শ্রমিকদের নিকট থেকে প্রথমে চাঁদা দাবি করে ও পরবর্তীতে কাজ বন্ধ করার হুমকি দেয়।

“কিন্তু সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই কাজ চলমান থাকায় কেএনএ সন্ত্রাসী দল গত ১১ মার্চ ১২ জন শ্রমিককে অপহরণ করে। এদের মধ্যে একজন শ্রমিক গুলিবিদ্ধ হন এবং চার জন শ্রমিককে এখনও কেএনএ জিম্মি করে রেখেছে। বাকি সাত শ্রমিককে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দিলেও তাঁদেরকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ না করার জন্য হুমকি দেয় এবং কেএনএ রোববার সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর গুলিবর্ষণ করে,” বলা হয় আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে।

এতে বলা হয়, গত ৮ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের তিন উপজেলায় গাড়ি চলাচল বন্ধের জন্য কেএনএ পরিবহণ মালিক সমিতিকে হুমকি দিয়ে নোটিশ জারি করে।

কেএনএ সদস্যদের বিবিধ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দ্বারা সৃষ্ট নিরাপত্তাজনিত কারণে গত রোববার (১২ মার্চ) ওই এলাকায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে জেলা প্রশাসন।

এছাড়াও কেএনএ’র নির্যাতনে স্থানীয় বিভিন্ন পাহাড়ি সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠী ঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন বলেও দাবি করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

আইএসপিআরের দাবি, কেএনএ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর চাঁদাবাজি, মাদকের চোরাচালান, অপহরণ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কারণে বর্তমান সরকারের বিবিধ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড, বেসরকারি বিনিয়োগ ও পর্যটন শিল্প বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যার সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।

“কেএনএ এর এই অপতৎপরতা দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পাশাপাশি বিশ্ব দরবারে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে এবং সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান শান্তি-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বিঘ্নিত করছে,” বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।

প্রসঙ্গত পাহাড়ের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপকে আইএসপিআর সংক্ষেপে কেএনএ বললেও র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) কেনএনএফ (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) হিসেবে পরিচয় দেয়।

নতুন জঙ্গি সংগঠনের ৯ সদস্য গ্রেপ্তার

রোববার দুপুরে জেলার রুয়াংছড়ি এলাকায় সেনা সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনার পর ওই রাতেই রুয়াংছড়ি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে টংকাবতী পাহাড়ি এলাকায় অভিযান চালায় র‌্যাব।

অভিযানে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের প্রশিক্ষণ কমান্ডার দিদার হোসেন ওরফে চাম্পাইসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। সোমবার ভোরে বান্দরবান সদরের টংকাবতী এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

এদিন দুপুরে বান্দরবান জেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন গণমাধ্যমকে এই তথ্য জানান।

খন্দকার মঈন বলেন, গত বছরের ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আটজন তরুণের নিখোঁজের ঘটনার পর নিখোঁজ তরুণদের পরিবার কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরির প্রেক্ষিতে র‌্যাব নিখোঁজদের উদ্ধারে নজরদারি বৃদ্ধি করে।

নিখোঁজ তরুণদের উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে র‌্যাব “জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া” নামক একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় থাকার তথ্য পায় এবং জানতে পারে যে, এই সংগঠনের সদস্যরা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সহায়তায় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে, জানান খন্দকার মঈন।

তিনি জানান, পার্বত্য এলাকায় গত বছরের ২০ অক্টোবর রাঙ্গামাটির বিলাইছড়ি ও বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থেকে এই জঙ্গি সংগঠনের সাত জন এবং পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তিন জনসহ মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে।

গত ১১ জানুয়ারি বান্দরবানের থানচি ও রোয়াংছড়ি থেকে পাহাড়ে প্রশিক্ষণরত পাঁচ সদস্যকে, গত ২৩ জানুয়ারি কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় এই সংগঠনের শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ও বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশারকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

এছাড়া গত ৭ ফেব্রুয়ারি বান্দরবানের থানচির রেমাক্রী ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি ও বিদেশি অস্ত্র, বোমা তৈরির সরঞ্জামাদি, গোলাবারুদ ও নগদ ৭ লক্ষাধিক টাকাসহ জঙ্গি সংগঠনের ১৭ জন এবং পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তিন জনসহ মোট ২০ জন এবং ১ মার্চ চট্টগ্রামের গহীনে সশস্ত্র প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া চার জঙ্গিকে চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাব কর্মকর্তা খন্দকার মঈন জানান, বিভিন্ন সময়ে র‌্যাবের পরিচালিত অভিযানে ইতোমধ্যে নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ সর্বমোট ৫৯ জন এবং পাহাড়ে অবস্থান, প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য কার্যক্রমে জঙ্গিদের সহায়তার জন্য পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ-এর ১৭ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পাহাড়ে এসব সহিংস ঘটনা ওই এলাকার সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে বলে দাবি পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মংসানু চৌধুরী।

তিনি বেনারকে বলেন, “একটি স্বার্থান্বেষী মহল সব সময়ই চায় পাহাড়ে শান্তি না আসুক। এর ফলে নানা সময় নানা ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাহাড়ের জনপদ।”

আদিবাসীদের জন্য নিজেদের ঘর নিজেদের ভূমি এখন নিরাপদ নয়। এভাবে চলতে থাকলে সার্বিক পরিস্থিতি ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, বলেন তিনি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।