নবায়ন চাকমাকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ অস্বীকার

কামরান রেজা চৌধুরী
2022.03.31
ঢাকা
নবায়ন চাকমাকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ অস্বীকার খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় নিহত ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নেতা নবায়ন চাকমা সৌরভ ওরফে মিলন চাকমার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ও স্মরণসভা। ২৩ মার্চ ২০২২।
[সৌজন্যে: ইউপিডিএফ]

পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সদস্য নবায়ন চাকমা মিলনকে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করেছে নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

বাংলাদেশ সময় বুধবার রাতে দেয়া এক বিবৃতিতে ১৫ মার্চ মিলনের ‘বিচারবহির্ভূত’ হত্যার শিকার হওয়া সম্পর্কে তদন্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান সংগঠনটি পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস।

আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন চিটাগাং হিল ট্র্যাকটস কমিশনের বরাত দিয়ে এইচআরডব্লিউ জানায়, মিলনের মৃত্যুসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া সকল বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই হত্যাকাণ্ডে নিরাপত্তা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করা হয়েছে।

সশস্ত্রবাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের পরিচালক লে. কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় নবায়ন চাকমা মিলনের মৃত্যুর বিষয়টি সশস্ত্রবাহিনী অবগত নয়।

দীঘিনালায় ইউপিডিএফ নেতা মিলনের মৃত্যুর ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “পার্বত্য চট্টগ্রামে যে হানাহানি ও সহিংসতা হয়, সেগুলো হয় মূলত সেখানকার বিভিন্ন উপজাতীয় বা আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বিরোধের কারণে। সেখানে (দীঘিনালায়) তো পুলিশ নেই। সুতরাং পুলিশ অথবা নিরাপত্তা বাহিনী কাউকে হত্যা করেনি।”

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের অভিযোগ “সঠিক নয়” বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. দবিরুল ইসলাম বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “আসলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে আমরা কোনো  পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ পাইনি।”

তিনি বলেন, “আমাদের কাছে যদি কেউ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করেন সেক্ষেত্রে আমরা বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখব।”

কীভাবে মারা গেলেন মিলন?

ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, নবায়ন চাকমার মর্মান্তিক মৃত্যু পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাদেশি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ঘটে যাওয়া সর্বশেষ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা।

একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড নেয়ার জন্য মিলনকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পেটাতে থাকে।

ওই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা মিলনকে ঘাড়ে তুলে নিয়ে চলে যায়। তখন মিলন ছিলেন অর্ধমৃত।

চার ঘণ্টা পর দীঘিনালা হাসপাতালে তাঁকে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শীকে উদ্ধৃত করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, মিলনকে হাত-পা বেঁধে লাঠি ও বন্দুক দিয়ে পেটানো হয়। তিনি জানান, তাঁকে ফুটবলের মতো লাথি মারা হচ্ছিল। তাঁর হাত-পা ভেঙ্গে যায়।

সকল গ্রুপকে একই নজরে দেখতে হবে

ইউপিডিএফ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, নবায়ন চাকমার স্মরণে ২৩ মার্চ দীঘিনালায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ওই সভায় ইউপিডিএফ নেতা বিপুল চাকমা বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে শুধু নবায়ন চাকমা মিলনকে হত্যা করা হয়নি। দীঘিনালায় ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট ইউপিডিএফ'র তিন সদস্য, নবীন জ্যোতি চাকমা, ভূজেন্দ্র চাকমা ও রুচিল চাকমাকে রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে গুলি করে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

বিপুল চাকমা বলেন, “২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল রাঙ্গামাটির নান্যাচরে কলেজ ছাত্র রমেল চাকমাকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের ৯ এপ্রিল ইউপিডিএফ সংগঠক মাইকেল চাকমাকে গুম করা হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত আরো বহু নেতা-কর্মিকে বিচার বহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সকল বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনায় জড়িতদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে।”

দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল। সেখানে ঐতিহাসিকভাবে মূলত বিভিন্ন ‘উপজাতীয়’ গোষ্ঠী বাস করে। সেকারণে উপজাতীয় গোষ্ঠীগুলো নিজেদের আদিবাসী বলে দাবি করে।

তবে সরকার তাঁদের আদিবাসী হিসাবে স্বীকৃতি দেয় না। পার্বত্য শান্তি চুক্তিতেও সেখানকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে উপজাতি হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা আছে।

১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে সেখানকার মূল দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগঠন শান্তি বাহিনী।

জনসংহতি সমিতির মূল নেতা ছিলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, যিনি পরবর্তীতে দলীয় কোন্দলে খুন হন।

জনসংহতি সমিতির অভিযোগ সরকার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকার দিচ্ছে না। সেসময়ে তাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, সরকার সমতলের বাঙালি মুসলমানদের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে বসতি স্থাপন করছে।

১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে জনসংহতি সমিতির সাথে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে আওয়ামী লীগ সরকার।

চুক্তিতে সেই করেন গেরিলা নেতা ও মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ভাই সন্তু লারমা ও তখনকার চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ।

শান্তি চুক্তি অনুযায়ী সরকার অনেক সেনা চৌকি প্রত্যাহার করেছে।

শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে জন সংহতি সমিতির আরেক অংশ ইউপিডিএফ। পরে ইউপিডিএফ‘র মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে সংঘাত শুরু হলে নতুন করে জন্ম হয় ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক নামক আরেক সংগঠনের। তারা প্রায়ই সহিংস সংঘাতে লিপ্ত হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বিশ্লেষক গৌতম দেওয়ান বৃহস্পতিবার বেনারকে বলেন, “নবায়ন চাকমার হত্যাকাণ্ড সত্যিই দুঃখজনক। এই রকম বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড মেনে নেয়া যায় না। এমনকি কোনো  সন্ত্রাসীকেও এভাবে হত্যা করা যায় না; তাঁরও বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।”

তিনি বলেন, “সরকার যদি পার্বত্য চট্টগ্রাম সন্ত্রাস দমন করতে চায় তাহলে সকল গ্রুপকে একই নজরে দেখতে হবে। অন্যথায় সমস্যা থেকেই যাবে এবং এর পরিণতি ভালো হবে না।”

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ২০২০ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেই বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনী হাতে ১৩৯টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিনজনকে বিচারবিহর্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে, ৫০ জনকে কোনো অপরাধ ছাড়াই আটক করা হয়েছে, ৫৪ জনকে পেটানো হয়েছে।

জনসংহতি সমিতির অভিযোগকে “মিথ্যা“ আখ্যা দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বেনারকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে যত খুন-খারাবি হয় সেগুলোর অধিকাংশই করে জনসংহতি সমিতি এবং তারা সরকারের বিরুদ্ধে মনগড়া বিভিন্ন অভিযোগ করে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।