বান্দরবানে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় গোলাগুলি, ৮ জনের লাশ উদ্ধার
2023.04.07
কক্সবাজার ও ঢাকা

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে পুলিশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর আট যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে। দুটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় তাঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানালেও গ্রুপগুলোর পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
স্থানীয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মান্নান বেনারকে বলেন, শুক্রবার (৭ এপ্রিল) সকালে রোয়াংছড়ির খামতাম পাড়া এলাকা থেকে আট জনের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। নিহতদের কাছ থেকে দেশীয় দুটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
“তবে কে বা কারা তাঁদের হত্যা করেছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। মরদেহগুলো কোন গ্রুপের তাও বলা যাচ্ছে না,” বলেন ওসি মান্নান।
তবে তিনি নিহতদের মধ্যে সাত জনের নাম নিশ্চিত হওয়ার কথা জানান। তারা হলেন; ভানদু বম, সাং খুম, সান ফিরথাং বম, বয়রেম বম, জাহিম বম, লাল লিয়ান ঙাক বম ও লালঠা জার বম।
এ বিষয়ে বান্দরবন জেলা পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “পাহাড়ের দুটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় যে আটজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তাদের পরনে একটি বিশেষ ইউনিফর্ম ছিল। কী নিয়ে এই গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, তা তদন্ত চলছে। ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
এদিকে সম্প্রতি ইসলামি উগ্রবাদী একটি জঙ্গি গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আলোচনায় আসা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) নামে পরিচালিত একটি ফেসবুকে পেইজ থেকে দাবি করা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে সাতজনই কেএনএফ সদস্য।
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকেই গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান তাঁরা। পরে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেন এলাকাবাসী।
তাঁদের ধারণা, নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কেএনএফ ও অন্য কোনো সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটতে পারে।
খামতাম পাড়ার কারবারি মানিক খিয়াং বেনারকে বলেন, “বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। আমরা নিজেদের বাসায় বসে গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছিলাম।”
তিনি বলেন, স্থানীয়দের ধারণা, কেএনএফের সঙ্গে অন্য কোনো গ্রুপের সংঘর্ষ হয়ে থাকতে পারে। কারণ এই এলাকায় কেএনএফ বেশ সক্রিয়।
বাড়িঘর ছেড়েছেন স্থানীয়রা
বৃহস্পতিবার রাতে গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর থেকে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১১টার পর আটটি গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধারের পর আতঙ্ক আরো বাড়তে থাকে স্থানীয়দের মধ্যে।
এই পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার অভাবে খামতাম পাড়ার ১৭৫টি পরিবার রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
মানিক খিয়াং বলেন, “গোলাগুলির ঘটনার পর ভয়ে অনেক পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে চলে যায়। অর্ধশতাধিক পরিবার বাড়ি ছেড়ে গেছে বলে জানতে পেরেছি। এর মধ্যে অনেকে আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিয়েছে।”
রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উ হ্লাং মং মার্মা বেনারকে বলেন, “উপজেলা সদরের বম কমিউনিটি সেন্টারে ৪০ জন নারী ও শিশু এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।”
রোয়াংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খোরশেদ আলম বেনারকে বলেন, “ওই পাড়ায় ১৭৫টি পরিবার আতঙ্কে রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তাঁদের দেখভাল করছে উপজেলা প্রশাসন।”
আশ্রয় নেয়া পরিবারগুলোর খাবারসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে খোঁজ রাখা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ওই এলাকা শান্ত হলে তাঁদের ফেরত পাঠানো হবে।
পাহাড়ে অশান্তির পেছনে স্বার্থান্বেষী মহল
পার্বত্যাঞ্চলে শান্তি থাকুক এটা কোনোভাবেই চায় না এমন একটি স্বার্থান্বেষী মহল পাহাড়ি এলাকায় সক্রিয় রয়েছে বলে দাবি পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সদস্য অধ্যাপক মংসানু চৌধুরীর।
বেনারের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, পাহাড়ে একটি শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী গ্রুপ আছে, যারা কোনো অবস্থায় পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক-এটা চায় না। তবে তিনি এই গ্রুপ সম্পর্কে কিছু বলতে চাননি।
তিনি বলেন, পাহাড়ে সশস্ত্র গ্রুপের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে। কীভাবে এরা বাড়ছে, কারা তাদের তৈরি করছে, প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, অস্ত্র দিচ্ছে- এসব প্রশ্ন জনমনে আছে।
“যারা এসব সশস্ত্র গ্রুপ জন্ম দিচ্ছে, তারা তাদের প্রয়োজনে এসব গ্রুপ আবার ভেঙেও দিচ্ছে। কেএনএফও হয়তো তেমনি একটি গ্রুপ।”
যদিও গত ২০ অক্টোবর ২০২২ বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করলেও সংগঠনটি তাদের ফেসবুক পাতায় দাবি করেছে তারা বাংলাদেশের কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়। একই সাথে তারা জানিয়েছে, তাদের ভাষায়, “সুবিধা বঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর জন্যে স্বশাসিত বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট রাজ্য” চাইলেও তারা কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি।
সম্প্রতি বেনারের সাথে আলাপকালে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান বলেন, “কেএনএফের হঠাৎ আবির্ভাব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কাছে বিস্ময়। কীভাবে এসব গ্রুপের জন্ম হয়ে, কেন হয় তা সত্যিই উদ্বেগের।”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বেনারকে বলেন, পাহাড়ে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এসব গ্রুপ নিজেদের মধ্যে আধিপত্য নিশ্চিত করতে প্রায়ই সংঘাতে লিপ্ত হয়।
“মূলত চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন দখলদারিত্ব ঠিক রাখতে এই গ্রুপগুলো নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে,” বলেন তিনি।
তিনি মনে করেন, দীর্ঘদিন থেকেই এই গ্রুপগুলোর মধ্যে বৈরিতা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে কেএনএফ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে আকার ধারণ করেছে। যার ফলে একের পর এক লড়াই হচ্ছে এবং মানুষের প্রাণ যাচ্ছে।
“অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের মাধ্যমে ওদের তৎপরতা কমিয়ে আনতে না পারলে পাহাড়ে সংঘাত নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সক্রিয় হওয়া,,” যোগ করেন আবদুর রশীদ।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ বান্দরবানের রুয়াংছড়িতে কেএনএফ সদস্যদের অতর্কিত হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান এবং দুই জন সেনা সদস্য আহত হন।