পাহাড়ি ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে গণপিটুনিতে শিক্ষক নিহত
2024.10.01
ঢাকা
পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়িতে একজন বাঙালি শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষেতে ওই জেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন।
খাগড়াছড়ি সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুজন চন্দ্র রায় বেনারকে বলেন, “পৌরসভা ও জেলা সদরে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বলবৎ থাকবে। ফলে, এই এলাকায় কোনো প্রকার সভা-সমাবেশ করা যাবে না।”
পার্বত্য এলাকায় দুই সপ্তাহ আগে তিনজন পাহাড়ি ও এক বাঙালির মৃত্যুর ঘটনায় যে অস্থিরতা বিরাজ করছে, তা শিক্ষক মৃত্যুর ঘটনায় নতুন করে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছে পুলিশ ও স্থানীয়রা।
ইউএনও জানান, মঙ্গলবারের সংঘর্ষে তিনি নিজে, অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
পরিস্থিতি বিবেচনায় ইতোমধ্যে জেলায় সেনাবাহিনী ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে জানিয়ে ইউএনও বলেন, এ ঘটনার দুই পক্ষই আবার মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে।
মঙ্গলবারের ঘটনায় সদরের মহাজনপাড়ার কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করা হয়েছে, একটি বাড়িতে আগুন লাগানোর খবর প্রকাশ হয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমে।
অধ্যক্ষের কক্ষেই শিক্ষককে হত্যা
স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ জানিয়েছে, খাগড়াছড়ি সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আবুল হাসনাত মুহাম্মদ সোহেল রানার বিরুদ্ধে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ উঠে। পরে বিক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। এক পর্যায়ে শিক্ষক সোহেল রানাকে অধ্যক্ষের কক্ষে আটকে রাখা হয়। বেশ কয়েকজন পাহাড়ি তরুণ সেখানেই অভিযুক্ত শিক্ষককে গণপিটুনি দেয়।
সংঘর্ষের বেশ কিছু ভিডিও ইতোমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, ওই শিক্ষককে পেটাচ্ছে বিক্ষুব্ধ আদিবাসী শিক্ষার্থীরা।
খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল বাতেন মৃধা বেনারকে জানান, পুলিশ ওই শিক্ষককে উদ্ধার করে খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
এই ঘটনায় উদ্ধার কাজে গিয়ে তিনি নিজেও কিছুটা আহত হয়েছেন জানিয়ে ওসি বলেন, “পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”
খাগড়াছড়ি জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. রিপল বাপ্পি চাকমা বেনারকে বলেন, “পিটুনিতে আহত ওই ব্যক্তি মূলত হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা গেছেন। ময়নাতদন্ত শেষে বিস্তারিত জানা যাবে।”
ধর্ষণের অভিযোগে কারাগারে ছিলেন এই শিক্ষক
স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, খাগড়াছড়ি সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিল্ডিং কনস্ট্রাকশন ও সেফটি বিভাগের চিফ ইনস্ট্রাক্টর সোহেল রানা ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে জেলে গিয়েছেন। তিন মাস আগে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
সোহেল রানা যাতে এই প্রতিষ্ঠানে আর ফিরতে না পারেন শিক্ষার্থীরা এমন দাবি করে আসছিল। এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে আবার শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে।
নতুন করে সহিংসতার আশঙ্কা পাহাড়ে
গত জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর দেশের বিভিন্নস্থানে গণপিটুনিতে মৃত্যুর ঘটনা দেখা গেলেও পাহাড়ের সহিংসতা নানা মহলে উদ্বেগ তৈরি করেছে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি সদরে মো. মামুন নামে এক যুবককে মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় মামুনের স্ত্রী হত্যা মামলা করেন পলাতক তিন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। তবে মামুনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি–বাঙালি সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে।
১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালার লারমা স্কয়ারের দোকানপাটে আগুন দেওয়া হয়। সংঘাতে দীঘিনালায় ধনঞ্জয় চাকমা নামের এক ব্যক্তি মারা যান। ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি সদরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে রুবেল ত্রিপুরা ও জুনান চাকমা নামের দুজন মারা যান। ২০ সেপ্টেম্বর এ ঘটনার জের ধরে রাঙামাটিতে সংঘর্ষ হয়। সেখানে দোকানপাট ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়। অনিক কুমার চাকমা নামের একজন মারা যান।
পরিস্থিতি সামাল দিতে ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। পরে তা তুলে নেওয়া হয়। এসব ঘটনায় দুই জেলায় পাঁচটি মামলা হয়েছে।
সে সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই জেলায় সহিংসতার পর সেখানে সফর করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.), পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সাবেক রাষ্ট্রদূত (অব.) সুপ্রদীপ চাকমা, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ।
স্থানীয়দের সঙ্গে ওই বৈঠকের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলেও মঙ্গলবারের ঘটনায় আবারো পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “পাহাড়ে যে সমস্য বিরাজ করছে সেটিকে শক্তি দিয়ে নয় সম্প্রতির বন্ধন নিশ্চিত করে মোকাবেলা করতে হবে। এখানে নানা স্বার্থান্বেষী মহল নানাভাবে সংঘাত উসকে দিতে চায়, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ সেখানে সংঘাত সৃষ্টি করতে চায় বলেই মনে হচ্ছে।”
এমদাদুল ইসলাম বলেন, “পাহাড়ে নানা ইস্যু আছে; সেগুলোকে যেমন মোকাবেলা করতে হবে তেমনি পারস্পরিক সম্পর্কগুলো উন্নত করতে ভূমিকা রাখতে হবে। এখানে সকল রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনকে কাজ করতে হবে।”
সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, “পরিস্থিতি বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট সকল কর্তৃপক্ষকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ সরকার পরিবর্তন হলেও পার্বত্য এলাকায় পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হয়নি বরং অবনতির চেষ্টা প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে।”
উল্লেখ্য, পাহাড়ে দুই দশকের সশস্ত্র লড়াইয়ের ইতি হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ২ জুলাই এক শান্তি চুক্তির মাধ্যমে। চুক্তির মূল কথা কথা ছিল, পার্বত্য অঞ্চল পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং সে জন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এবং আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল। পাহাড়িরা বলে আসছেন, সেই চুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। অন্যদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, চুক্তির প্রায় সব বিষয় মেনে নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে পাহাড়ে বাঙালি ও পাহাড়িদের মধ্যে সংঘাত মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।