মৌসুম শেষ হলেও ইলিশের দেখা কম
2023.09.26
ঢাকা
পরপর তিন মাস তিন দফা ঝড়-তুফানের কারণে সাগর উত্তাল থাকায় চলতি মৌসুমে পর্যাপ্ত ইলিশ ধরতে পারেননি উপকূলের জেলেরা।
বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে সাগরের উপরিভাগে পানির তাপমাত্রা বেড়ে সাগর উত্তাল হচ্ছে। এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।
ট্রলার মালিকরা বলছেন, ১২ অক্টোবর থেকে ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হতে যাচ্ছে। এর আগে অবস্থার পরিবর্তন না হলে এবার প্রতি ট্রলারের বিপরীতে পাঁচ লাখ টাকা করে তাঁদের লোকসান গুনতে হবে।
দেশের প্রায় পাঁচ লাখ জেলে ইলিশ শিকারের ওপর নির্ভরশীল। উপকূলীয় জেলা বৃহত্তর বরিশাল, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের আরো অন্তত ২০ লাখ মানুষের আয়ের একটি অংশ এই মাছের ওপর নির্ভর করে।
এছাড়া, শতকরা প্রায় ১২ শতাংশ ইলিশ দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ করে।
বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “এ বছর ইলিশ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে মূলত ঝড়-তুফানের কারণে। শতকরা ৮৫ শতাংশ ইলিশ মাছ ধরা পড়ে সাগরে এবং বাকি ১৫ ভাগ পড়ে নদীতে, যে সময়ে সবচেয়ে বেশি মাছ ধরা পড়ে, সে সময় সাগর উত্তাল ছিল। ফলে মাছ পাননি জেলেরা।”
তিনি আরও বলেন, “২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। জেলেরা ২৩ জুলাই থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত মাছ ধরেছেন। ২৮ জুলাই থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত ঝড়-তুফানের কারণে সাগর উত্তাল থাকায় তাঁরা ইলিশ ধরতে পারেননি। এরপর ১২ আগস্ট থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত সাগর পুনরায় উত্তাল হয়ে পড়ায় জেলেরা সাগরে যেতে পারেননি।”
“এ মাসের ১২ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর সাগর উত্তাল ছিল। জেলেরা মাছ ধরতে পারেননি,” বলেন তিনি।
বিশ্বজিৎ বলেন, “২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে সাগর এত বেশি উত্তাল ছিল না। যে কারণে জেলেরা প্রচুর মাছ পেয়েছেন।”
তিনি জানান, গত মাসে বরগুনায় পাঁচ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা পড়েছে।
বিশ্বজিৎ বলেন, “চাঁদপুর ও ভোলায় মেঘনার মোহনায় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেখা যাচ্ছে সেখানেও ইলিশ তেমন ধরা পড়ছে না।”
দেশের অন্যতম বৃহৎ ইলিশ আহরণকেন্দ্র বরগুনা জেলার পাথরঘাটা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মান্নান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “এ বছর নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। তিন দফায় সাগরে ঝড়-তুফান হয়েছে। আমরা ট্রলার পাঠাতে পারিনি, মাছ ধরা সম্ভব হয়নি। প্রত্যেক ট্রলারে পাঁচ লাখ টাকা করে ক্ষতি হবে।”
তিনি বলেন, “যদি আগামী কয়েকদিন আবহাওয়া পরিষ্কার থাকে তাহলে আমাদের ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কমবে। আমরা সাগরে এত ঘনঘন ঝড়-তুফান দেখিনি।”
ভোলার ইলিশ্যা এলাকার বাসিন্দা ও মৎস্যজীবী মনির হোসেন মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “আমরা এ বছর একদম মাছ পাচ্ছি না। গত কয়েক বছর খুব ভালো মাছ পেয়েছি। এবার কীভাবে চলব বুঝতে পারছি না।”
কেন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সাগরের পানি দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে নদীর দিকে উঠে এলে ইলিশ মাছ বেশি পাওয়া যায়। এবার মেঘনায় স্রোত বেশি থাকায় জোয়ারের পানি ঢুকতে পারছে না। তাই, মাছ মিলছে না।”
মনির বলেন, “অন্যান্য বছর ইলিশের পেটে ডিম থাকে। এবার তেমন মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। ডিম না থাকলে তো পরের বছর মাছ পাওয়া যাবে না!”
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার বাংলাদেশের উজানে অবস্থিত ভারতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। বন্যা থেকে বাঁচতে বাড়তি পানি ব্যারেজ দিয়ে ছেড়েছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। ফলে তিস্তাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীতে পানির স্রোত বেড়েছে।
‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে’
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের উপপরিচালক অধ্যাপক মিজান আর. খান মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বঙ্গোপসাগরের প্রতিবেশ নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। সাগর বেশি বেশি উত্তাল থাকবে।”
তিনি বলেন, “বঙ্গোপসাগরের পানির উপরিভাগে তাপমাত্রা সাধারণত ২২ থেকে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। এ বছর সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই তাপমাত্রা ৩২-৩৪, এমনকি ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছে।”
অধ্যাপক মিজান বলেন, “সাগরের পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ঝড়-তুফান হবে এটিই স্বাভাবিক। সুতরাং এ বছর যা হচ্ছে সেটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হয়ে থাকতে পারে। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আরও সময় এবং গবেষণা প্রয়োজন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. হাসান ফারুক মঙ্গলবার বেনারকে বলেন, “ইলিশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নির্ধারণে গবেষণা চলছে। তবে ইলিশের প্রজননসহ উৎপাদনের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রয়েছে।”
“সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, ছোট অবস্থায় পরিপক্ক হয়ে যাচ্ছে ইলিশ। সাধারণত ডিম ছাড়তে ইলিশের এক বছর সময় প্রয়োজন হয়। এখন সাত থেকে আট মাসের মধ্যেই ইলিশের পেটে ডিম আসছে। ফলে ডিমের পরিমাণ কম হচ্ছে, বাচ্চাও কম হচ্ছে,” যোগ করে হাসান ফারুক।
সাগরের পানির তাপমাত্রা ইলিশ উৎপাদন ও প্রজননের সঙ্গে সম্পর্কিত উল্লেখ করে হাসান ফারুক বলেন, “অনেক সময় দেখা যায়, ইলিশ তার সহায়ক পরিবেশ না পেলে গতিপথ পরিবর্তন করে অন্যদিকে চলে যায়।”
বাংলাদেশ মৎস্য বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ইলিশ ধরা পড়েছে।
ভারতে পদ্মার ইলিশ রপ্তানি
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পূজাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ইলিশের কদর রয়েছে।
সেকারণে প্রতিবছর পশ্চিমবঙ্গের সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ রপ্তানি করে বাংলাদেশ। রপ্তানির এই পরিমাণ প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারি হিসাবে, ২০১৯ সালে ৫০০ মেট্রিকটন ইলিশ রপ্তানি করা হলেও ২০২৩ সালে সেই পরিমাণ প্রায় চার হাজার মেট্রিকটনে দাঁড়িয়েছে।
২১ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পেট্রাপোল স্থল সীমান্ত দিয়ে নয়টি ট্রাকে প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৪৫ মেট্রিক টন পদ্মার ইলিশ বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাঠানো হয়েছে।
প্রতিটি ইলিশ ৮০০ গ্রাম থেকে শুরু করে দেড় কেজি ওজনের। আগামী ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে বাকি ইলিশ ভারতে পৌঁছবে।