মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে শান্তিরক্ষা মিশনে র‍্যাবকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে জাতিসংঘে ১২ আন্তর্জাতিক সংস্থার চিঠি

আহম্মদ ফয়েজ
2022.01.20
ঢাকা
মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে শান্তিরক্ষা মিশনে র‍্যাবকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়ে জাতিসংঘে ১২ আন্তর্জাতিক সংস্থার চিঠি ঢাকার একটি সন্দেহভাজন জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের আগে স্থানীয় মানুষদের সরিয়ে নিচ্ছেন র‍্যাব সদস্যরা। ৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭।
[এপি]

আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০২১। ইস্টার্ন সময় বিকেল ০৫:০০

নির্যাতন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‍্যাব) শান্তিরক্ষা মিশনে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে জাতিসংঘকে লেখা চিঠিটি বৃহস্পতিবার সাধারণের জন্য প্রকাশ করেছে ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা।

এ বিষয়ে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যাঁ পিয়েরে ল্যাকরোইক্সকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ ১২টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা চিঠিটি দেয় গত বছরের ৮ নভেম্বর। তখন এটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়নি।

চিঠির সঙ্গে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। তবে চিঠি দেবার দু মাস পার হয়ে গেলেও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই চিঠির আনুষ্ঠানিক কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশর মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামালের মতে, “সরকারের উচিত অভিযোগ অস্বীকার না করে বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং জোরপূর্বক গুমসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করা।”

তিনি বেনারকে বলেন, “স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো র‌্যাব এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে প্রশ্ন তুললেই সরকার তাদের বিরুদ্ধে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগ তোলে।”

“পাশাপাশি তারা (কর্তৃপক্ষ) বরাবরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে। সেজন্য তারা (আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) মানবাধিকার লঙ্ঘন করেই চলেছে,” বলেন সুলতানা কামাল।

এদিকে ১২ সংস্থার চিঠিটি না দেখে এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।

তবে তিনি বেনারকে বলেন “বাংলাদেশ সরকার জনগণের অধিকারকে সম্মান করে, তাই যে কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে আনা মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি অভিযোগ তদন্ত করছে।”

বৃহস্পতিবার এইচআরডব্লিউ’র ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা ওই চিঠিতে স্বাক্ষর করা অন্য সংস্থাগুলো হলো; এশিয়ান ফেডারেশেন এগেইনস্ট ইনভলান্টারি ডিসাপিয়ারেন্সেস (এএফএডি), এশিয়ান ফোরাম ফর হিউম্যান রাইটস এন্ড ডেভেলপমেন্ট (ফোরাম- এশিয়া), এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস (এএনএফআরইএল), ক্যাপিটল পানিশমেন্ট জাস্টিস প্রজেক্ট, সিভিকাস: ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, রবার্ট এ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস এবং দ্য অ্যাডভোকেটস ফর হিউম্যান রাইটস এবং ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন এগেইনস্ট টর্চার (ওএমসিটি)।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতিসংঘের মুখপাত্র ফারহান আজিজ শুক্রবার এক ইমেইল বার্তায় বেনারকে জানান, র‍্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়টি তাঁরা অবগত রয়েছেন। তবে সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করার দায়িত্ব প্রতিটি বাহিনীর দেশীয় কর্তৃপক্ষের।

র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন “জাতিসংঘে একটি ইউনিট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত নয়,” বলেও জানান ফারহান।

র‌্যাবের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

র‍্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেছেন, র‌্যাবের ওপর অবিচার করা হচ্ছে।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “র‌্যাব যারা তৈরি করেছেন, এখন তারাই র‌্যাবকে অপছন্দ করছেন। র‌্যাবের বিরুদ্ধে নানান ধরনের অপপ্রচার করছেন।”

প্রসঙ্গত, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০৪ সালে র‌্যাব গঠন করা হয়। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হওয়ার আগে বেশ কয়েকবার র‌্যাব বিলুপ্ত করার দাবি জানান।

“তারা (মানবাধিকার সংগঠন) নানা ধরনের মানবাধিকারের কথা বলে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, এমন কোনো দেশ নাই যেখানে এনকাউন্টার বা এই ধরনের ঘটনা ঘটে না। পুলিশ বাহিনীর সামনে কেউ যদি অস্ত্র তুলে কথা বলে, পুলিশ বাহিনী তো তখন নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে না। তখনই এই ফায়ারিংয়ের ঘটনা ঘটে,” র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের বিষয়ে বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “সবই যদি এলিট ফোর্স, র‌্যাবের ঘাড়ে দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে আমি মনে করি, তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে।”

র‌্যাবের ভালো কাজের কথা বলা হচ্ছে না মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “র‌্যাব যে মাদকের বিরুদ্ধে, ভেজাল দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে, জলদস্যু মুক্ত করছে, উগ্রপন্থীদের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে যাচ্ছে, তারা যে সব সময় জঙ্গি দমন করছে, সন্ত্রাস দমনের জন্য কাজ করছে, সেই কথাগুলো তারা বলছে না।”

যা আছে চিঠিতে

চিঠিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলেছে, র‌্যাবের কিছু কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতনসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা অভিযোগ রয়েছে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন থেকে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে।

চিঠিতে জাতিসংঘের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার আগে একটি যাচাই পদ্ধতি চালু করা উচিত, যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতনের অভিযোগও তদন্ত করে দেখা হবে।

জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারিকে লেখা চিঠিতে বলা হয়, “বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ সেনা ও পুলিশ মোতায়েনকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০২০ সালে দেশটি বিভিন্ন মিশনে ৬ হাজার ৭৩১ জন ইউনিফর্মধারী কর্মী মোতায়েন করে সর্বোচ্চ অবদান রাখে।”

সংস্থাগুলো জানায়, “গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে জানাচ্ছি যে জাতিসংঘের ২০১২ সালের পলিসি অন হিউম্যান রাইটস স্ক্রিনিং অব ইউনাইটেড ন্যাশনস পারসোনাল বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না।”

চিঠিতে বলা হয়, “যেসব ব্যক্তি র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) সঙ্গে কাজ করেছেন তাদের জাতিসংঘ মিশনে পাঠানো হচ্ছে। ২০০৪ সালে এই ইউনিটটি গঠিত হওয়ার পর থেকে এর সদস্যদের মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতন এবং জোরপূর্বক গুম করার ধারাবাহিক ও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকার পরও।”

“২০২১ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট উল্লেখ করেছেন, র‌্যাবের বিরুদ্ধে নির্যাতন ও অশোভন আচরণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের এবং এটি উদ্বেগের বিষয়। র‌্যাবে চাকরি করছেন এমন ব্যক্তিদের ঘন ঘন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে মোতায়েন করা হয়, যা উদ্বেগজনক,” চিঠিতে বলা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচে জাতিসংঘের পরিচালক লুইস চারবোনেউ বলেছেন, “জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে র‌্যাবের সদস্যদের মোতায়েনের বিষয়টি একটি বার্তা দেয়। তা হলো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য একজনকে জাতিসংঘের চাকরি থেকে যদি বিরত রাখা না হয়, তাহলে জাতিসংঘ মিশনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে।”

“যেসব দেশ শান্তিরক্ষী নিচ্ছে এবং যারা এতে সেনা পাঠাচ্ছে, তাদেরকে জাতিসংঘের একটি স্পষ্ট সংকেত দেওয়া উচিত। তা হলো; নিপীড়ক ইউনিটগুলো জাতিসংঘের অংশ হতে পারবে না,” বলেন তিনি।

রবার্ট কেনেডি হিউম্যান রাইটসের প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি বলেছেন, জাতিসংঘের মহাসচিব যদি শান্তিরক্ষীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করায় গুরুত্ব দেন, তাহলে র‌্যাবের মতো নির্যাতনের প্রামাণ্য রেকর্ড আছে এমন ইউনিটকে মোতায়েনের বাইরে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে তথ্যপ্রমাণ পরিষ্কার। এখন এ বিষয়ে জাতিসংঘের একটি সীমারেখা টানার সময় এসেছে।

এর আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। গত ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে পৃথকভাবে এই নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট (রাজস্ব বিভাগ) ও পররাষ্ট্র দপ্তর।

এর মধ্যে আছেন বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান প্রধান বেনজীর আহমেদ। জাতিসংঘে তাঁর চাকরি করার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তিনি র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২০১৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত।

তবে টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বেনজীর আহমেদ বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যেসব মানুষ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে র‌্যাবকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছেন, তারা আমাদের সরকার এবং আমাদের দেশকে বিব্রত করার চেষ্টা করছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।