গুম কমিশনের প্রতিবেদনে ১০ চাঞ্চল্যকর তথ্য

শৈলজা নীলকান্তন
2024.12.20
ওয়াশিংটন
গুম কমিশনের প্রতিবেদনে ১০ চাঞ্চল্যকর তথ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে ঢাকার শহীদ মিনারে জড়ো হয়েছেন তাদের স্বজনেরা। ১১ আগস্ট, ২০২৪।
[মোহাম্মদ পনির হোসেন/রয়টার্স]

গা শিউরে ওঠা হত্যাকাণ্ড, রোজ নির্যাতন, হত্যার পর গল্প ফাঁদা কিংবা সাধারণ নাগরিকের ব্যক্তিগত কথোপকথনে আঁড়িপাতা--বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলের বলপূর্বক গুমের ঘটনার সারমর্ম এমনই, যা উঠে এসেছে অন্তর্বতী সরকারের গুম কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে।

এ ধরনের ঘটনার শিকার জীবিত ব্যক্তিদের দেয়া বর্ণনায় কীভাবে গুম করা হয়েছিল তা জানতে পেরেছে পাঁচ সদস্যের কমিশন।  সুপ্রিম কোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন গত সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

ভুক্তভোগী ছাড়াও সেনাবাহিনী এবং র‌্যাবসহ বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে কমিশন।

১২ বছরে ছয়শোরও বেশি গুমের জন্য র‌্যাবকে অভিযুক্ত করে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাহিনীটির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।  প্রায় দুই দশক আগে যাত্রা শুরু করা এই এলিট ফোর্স--র‌্যাব ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করেছে গুম কমিশন।   

1d2fa486-ac84-49f7-870e-462c29e923f8.jpeg
ঢাকার একটি বিশেষ আদালতে র‌্যাব সদস্যরা পাহারা দিচ্ছেন। ৫ নভেম্বর ২০১৩। [মুনির উজ জামান/এএফপি]

মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বেনারকে বলেন, “কমিশনের সদস্যরা সরাসরি বা দৃশ্যত রাজনীতিতে যুক্ত নন।  কাজেই হাসিনা বা তাঁর সমর্থকরা এই কমিশনের সদস্যদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করলে তা ধোপে টিকবে না।”

সহমত পোষণ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বেনারকে বলেন, “কমিশন প্রধানের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি রয়েছে।  অন্য চার সদস্য দীর্ঘকাল দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত করেছেন।” 

মোট ৭৫৮টি গুমের মামলার তদন্তের ভিত্তিতে কমিশনের তৈরি প্রতিবেদনে উঠে আসা ১০ চাঞ্চল্যকর তথ্য হলো;

১. কমিশন জানিয়েছে, বলপূর্বক অপহরণ ও গুমের ঘটনা সম্ভবত সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। তারা এক হাজার ৬৭৮টি অভিযোগ পেয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত যাচাই-বাছাই করা ৭৫৮টি অভিযোগের ২০৪ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। অর্থাৎ ২৭ শতাংশ এখনো নিখোঁজ। “হাসিনার শাসনামলে জনগণের উপর অভিনব কায়দায় এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে," প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

২. কমিশন জানিয়েছে, শুধু কয়েকজন খারাপ লোকের হাতে গুম সংঘটিত হয়নি; এর প্রতিটি পদক্ষেপ সূক্ষ্মতার সাথে সম্পন্ন হয়েছিল। ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সংস্থায় দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছিল।  এটি দুর্ঘটনাবশত ঘটে যাওয়া বলার সুযোগ নেই।

“একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড কাঠামোর অধীনে পরিকল্পিত কাজের প্রতিফলন এতে রয়েছে,” প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

25cc8871-c7b3-4596-8323-dc338bc29cbe.jpeg
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন মায়ের ডাকের প্রতিষ্ঠাতা হাজেরা খাতুনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। শেখ হাসিনার আমলে নিখোঁজ হওয়া ছেলে সাজেদুল ইসলাম সুমনের ছবি বুকে হাজেরা খাতুন। ১৩ আগস্ট ২০২৪। [ইন্দ্রনীল মুখার্জি/এএফপি]

৩. এতো লোক জড়িত থাকার পরেও কিভাবে এ চক্রটি দেড় দশক যাবত অগোচরে ছিল? কমিশন বলছে, সেটাও দুর্ঘটনাবশত ঘটেনি।  “বাহিনীগুলো অন্য সংস্থাগুলির উপর তাদের কর্মকাণ্ডের দায় চাপাত। বাহিনীগুলো নিজেদের মধ্যে ভুক্তভোগী আদান-প্রদান করত। এক বাহিনী অপহরণ করত, অন্য বাহিনী আটকে রাখত এবং তৃতীয় বাহিনী হত্যা করত অথবা ছেড়ে দিত,” কমিশন জানিয়েছে।

৪. প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুমের শিকার একজনকে ফিরিয়ে দেওয়ার সময় বলা হয়েছিল, হাসিনা তাকে "দ্বিতীয় সুযোগ" দিচ্ছেন, তবে শর্তসাপেক্ষে। “আপনাকে রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে হবে, দেশত্যাগ করতে হবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হলেই কেবল ফিরতে পারবেন।”

৫. এমনভাবে অপহরণ করা হতো যাতে আশেপাশের কেউ দেখতে না পায়। গুম-কর্মীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকার একটি বড় কারণ “গোপনে তুলে নিয়ে যাওয়া”। কমিশনের কাছে র‌্যাব এবং সেনা কর্মকর্তাদের দেয়া সাক্ষাৎকার অনুযায়ী ইলেকট্রনিক নজরদারি ছাড়া এ কাজ পুরোপুরি অসম্ভব ছিল।

93985e56-286d-4a3c-a2d5-9489ca4ccbf8.jpeg
শেখ হাসিনার আমলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জড়ো হয়েছেন তাদের স্বজনেরা। ১১ আগস্ট, ২০২৪। [মোহাম্মদ পনির হোসেন/রয়টার্স]

 

৬. ভুক্তভোগীদের একেক জনকে একেক সময় পর্যন্ত আটক রাখা হয়েছিল। কেউ কেউ ৪৮-৬০ ঘন্টা থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ বা মাস পর্যন্ত আটক ছিলেন। ক্ষেত্রবিশেষে আট বছর পর্যন্ত আটকের ঘটনা আছে।  কাউকে কাউকে বৈধ বন্দীদের সাথে রাখা হয়েছিল এবং কাউকে আবার রাখা হয় গোপন কক্ষে।  কমিশন আটটির বেশি গোপন আটককেন্দ্র চিহ্নিত করেছে বলে জানিয়েছে। 

৭. দেশজুড়ে অপহরণের চর্চায় লক্ষণীয় ধারাবাহিকতা এবং নির্যাতনের পন্থায় “অত্যন্ত নৃশংস ও ভয়ানকভাবে পদ্ধতিগত” সামঞ্জস্য পাওয়া গেছে। একজন ভুক্তভোগী বর্ণনা করেছেন, র‌্যাব “গরুর চামড়া সেলাই করার মতো করে” তাঁর দুই ঠোঁট সেলাই করে বন্ধ করে দিয়েছিল। আরেকজন বলেছেন, র‌্যাব তার কানে এবং যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দিয়েছিল।

f7f2eb34-6847-4038-91c1-06511c39b282.jpeg
নয়াদিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলছেন। ২২ জুন ২০২৪। [রয়টার্স]

৮. কমিশন জানিয়েছে, গুমের ঘটনা দুইভাবে পরিসমাপ্তি ঘটানো হতো–হয় হত্যা অথবা ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার আওতায় ছেড়ে দেওয়া। হত্যা করা হলে লাশ যাতে শনাক্ত করা কঠিন হয় তা নিশ্চিত করার চেষ্টা থাকতো। এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে এক ধরনের খেলায় মেতে উঠতো র‌্যাব এবং অন্যান্য বাহিনী সদস্যরা।

বেঁচে যাওয়া একজন বলেছেন, এক পুলিশ অফিসার তাঁকে মহাসড়কে একটি গাড়ির সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। কিন্তু গাড়িটি সরে যাওয়ায় বেঁচে যান ওই ব্যক্তি। এরপর ওই অফিসার আর দ্বিতীয়বার তাঁকে মারার চেষ্টা করেননি।

৯. যাকে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার অধীনে ছেড়ে দেওয়া ব্যক্তিরা হয়তো বেঁচে ফিরতেন, কিন্তু অপরাধীরা বিকৃত পন্থায় তাদের জীবন ধ্বংস করে দিত। তারা ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করতো, যা তাদের দুর্ভোগ স্থায়ী করে তুলত। বছরের পর বছর ধরে মামলার পেছনে ঘুরতে হতো," কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়। 

১০.  ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের বিজেপি সরকার হাসিনার দৃঢ় সমর্থক। এর আগে ভারতের কংগ্রেস সরকারও হাসিনা সরকারের পক্ষে ছিল। এই ঘনিষ্ঠতার আড়ালে কি অপহরণকৃত বাংলাদেশিসহ বন্দী বিনিময়ের ঘটনাও ছিল? দুটি মামলা পর্যালোচনা এবং র‌্যাবের গোয়েন্দা সংস্থায় নিযুক্ত সৈন্যদের সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তিতে কমিশন জানিয়েছে, এমনটি ঘটেছে।

 

প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ঢাকা থেকে জিয়া চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।