ফোনে আড়িপাতা: সংসদে বিরোধীদলের সমালোচনা

কামরান রেজা চৌধুরী
2023.02.08
ঢাকা
ফোনে আড়িপাতা: সংসদে বিরোধীদলের সমালোচনা ঢাকায় মেট্রোরেলের একটি স্টেশনে যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে মোবাইলে কথা বলছেন এক ব্যক্তি। সরকার ‘আইনসম্মতভাবে’ নাগরিকদের ফোনে আড়িপাতার উদ্যোগ নিচ্ছে বলে গত জানুয়ারিতে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বিরোধীদলের মতে আড়িপাতা সংবিধানের লঙ্ঘন। ২৮ জানুয়ারি ২০২৩।
[বেনারনিউজ]

আইনসম্মতভাবে আড়িপাতার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে—জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন ঘোষণার প্রায় এক মাস পর প্রথমবারের মতো আড়িপাতাকে “অন্যায়, অনৈতিক এবং সংবিধান লঙ্ঘন” উল্লেখ করে সরকারের সমালোচনা করেছে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি।

রাষ্ট্রপতির দেওয়া ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাবে আলোচনায় অংশ নিয়ে বুধবার বিরোধী দলীয় উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জি এম কাদের) এসব কথা বলেন। এর আগে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দলীয় কোনো সংসদ সদস্য ফোনে আড়িপাতা নিয়ে সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করেননি।

দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের প্রসঙ্গ তুলে ধরে জি এম কাদের বলেন, “একটি গোয়েন্দা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে আমাদের দেশে; ব্যাপকভাবে, সেটা আমরা বিভিন্ন সূত্র থেকে জানতে পারছি—সংবাদপত্র থেকে। ...সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবীর স্মার্ট ফোনে আড়িপাতা হচ্ছে। আর এতে ব্যবহৃত হচ্ছে ইসরাইলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপের তৈরি করা স্পাইওয়্যার পেগাসাস।”

তিনি বলেন, “সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ব্যতিরেকে বিশেষ ব্যক্তিগণকে টার্গেট করে তাঁদের ফোনে আড়িপাতা অনৈতিক ও বেআইনি। এগুলো ব্যবহৃত হয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত তাদের জন্য।” 

কাদের বলেন, “এখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বিশেষ করে যারা সরকারবিরোধী রাজনীতি করেন তাঁদের মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি অনুমোদন ব্যতিরেকে রেকর্ড করা হয়, শোনা যায়। যুক্তি হতে পারে, সরকার তাঁদের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলে মনে করে। তাহলে কি সরকার আর রাষ্ট্র একীভূত হয়ে গেছে?”

বিরোধীদলীয় উপনেতা বলেন, “আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে সকল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করতে চায় সরকার। ...রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর এ ধরনের আড়িপাতা, নজরদারি করে হয়রানি করা বিরোধীদের কথা বলা বা স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করা। কথা বলা মত প্রকাশের অধিকার সকলের জন্মগত অধিকার।”

“এ ধরনের আড়িপাতা সংবিধান লঙ্ঘন,” বলেন জি এম কাদের।

জি এম কাদেরের বক্তব্য বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা সংসদে কোনো মন্তব্য করেননি।

মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বুধবার বেনারকে বলেন, “উনি সংসদে এটা বললেন কিন্তু সরকার কি আড়ি পাতছে? এমন তো প্রমাণ নেই। সুতরাং, উনার মন্তব্য নিয়ে আমি মন্তব্য করব না।”

আড়িপাতার বিষয়ে জি এম কাদেরের অভিযোগের ব্যাপারে মন্তব্য চাইলে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শহীদুজ্জামান সরকার বুধবার বেনারকে বলেন, “এ ব্যাপারে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সরকার, মন্ত্রণালয় অথবা দলের পক্ষ থেকে আমার প্রতি কোনো নির্দেশনা নেই। তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য করব না।”

গত ১২ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শফিউল ইসলামের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সংসদকে জানান, সরকার আইনসম্মতভাবে আড়িপাতার উদ্যোগ নিচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদকে বলেন, “ইন্টারনেটে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দেশ ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে এনটিএমসিতে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে। একইসঙ্গে একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”

এনটিএমসি নামে পরিচিত ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে আড়িপাতা হয়। 

একটি অগ্রগতি

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান বুধবার বেনারকে বলেন, “আইন লঙ্ঘন করে সরকারি সংস্থাগুলো নাগরিকদের টেলিফোনসহ বিভিন্ন ডিভাইসে আড়ি পেতে চলেছে; নাগরিক গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে চলেছে।”

তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে সরকারকে কেউ জবাবদিহি করার চেষ্টা চালাচ্ছে না। বিরোধী শক্তি বিএনপি নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে কথা বলে যাচ্ছেন। সংসদের কাজ হচ্ছে সরকারকে জবাবদিহি করা কিন্তু সরকারকে বিভিন্ন অনৈতিক ও অন্যায় কাজের জন্য জবাবদিহি করার প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদ কোনো কাজ করতে পারছে না।”

নূর খান বলেন, “এতদিন পর আমরা দেখলাম সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা জি এম কাদের সরকারের আড়িপাতার ব্যাপারে সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করলেন, যা অন্যান্য সব বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের অনেক আগেই করা উচিত ছিল।”

“যাই হোক, এতকিছুর পর দেরিতে হলেও তিনি বিষয়টি সংসদে উত্থাপন করেছেন। এটি একটি অগ্রগতি। এর ফলে অন্যান্য সংসদ সদস্যরাও এই বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করবেন এবং সরকারের ওপর জনমতের চাপ সৃষ্টি হবে,” আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে পরিচিত সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি। তাঁর নেতৃত্বে দলটি ২০০৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে আসছে।

এরশাদের মৃত্যুর পরে দলের প্রধান তাঁর ছোট ভাই জি এম কাদের জাতীয় পার্টিকে সংসদে একটি শক্তিশালী এবং ‘প্রকৃত বিরোধীদল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন বলে ঘোষণা দেন।

তিনি শেখ হাসিনা সরকারের কঠোর সমালোচনা শুরু করেন এবং বলেন, জাতীয় পার্টি আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই।

এরপর থেকে জাতীয় পার্টিতে দেখা যায় সংকট। দলের একাংশের নেতৃত্ব দেন এরশাদের স্ত্রী এবং সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং অন্য অংশে জি এম কাদের। সম্প্রতি তাঁরা একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেছেন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।