পুরোনো আইসিটি আইনে আদিলুর রহমান খানসহ দুই মানবাধিকারকর্মীর কারাদণ্ড
2023.09.14
ঢাকা
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের দুই কর্মকর্তাকে বিতর্কিত আইসিটি আইনের অধীনে বৃহস্পতিবার দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি আদালত।
ইউরোপীয় সংসদ সদস্যরা দেশের অবনতিশীল অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশের একদিন পর বাংলাদেশের আদালত এই রায় দিলো।
ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এএসএম নাসিরুদ্দিনের বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর অধীনে দায়ের করা একটি মামলায় এই কারাদণ্ড দেন।
এই দুই মানবাধিকারকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলাম কর্মীদের বিরুদ্ধে পুলিশি অভিযানে নিহতের সংখ্যা সম্পর্কে অধিকারের ওয়েবসাইটে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করা হয়।
কারাদণ্ডের পাশাপাশি এই দু’জনকে ১০ হাজার টাকার অর্থদণ্ডও দেয়া হয়েছে জানিয়ে বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, রায় ঘোষণার পর আদিলুর রহমান খান ও এএসএম নাসির উদ্দিনকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
প্রিজন ভ্যানে নিয়ে যাওয়ার সময় আদিলুর সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
“আমি এই আদালতে ন্যায় বিচার পাইনি। এই রায়ের বিরুদ্ধে আমি হাইকোর্টে যাব,” বলেন তিনি।
দুই মানবাধিকারকর্মীর আইনজীবী রুহুল আমিন ভূঁইয়াও সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর মক্কেলরা ন্যায় বিচার পাননি এবং এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হবে।
এদিকে ‘অপরাধীদের’ সাজা বাড়াতে হাইকোর্টে আপিল করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নজরুল ইসলাম।
এই রায় ‘ন্যায় বিচারের পরিপন্থী’
রায় ঘোষণার সময় বেশ কয়েকজন মানবাধিকারকর্মী এবং বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধি আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের একজন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন।
“আদিলুর রহমান খান একজন সুপরিচিত অধিকারকর্মী। আজ আইসিটি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারায় তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এই রায় মানবাধিকার ও ন্যায় বিচারের পরিপন্থী,” বেনারকে বলেন নুর খান লিটন।
মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে দায়ের এই মামলায় ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট আদিলুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।
ওই বছরের ১১ আগস্ট অধিকার অফিস থেকে দু’টি ডেস্কটপ ও দু’টি ল্যাপটপ জব্দ করা হয়। ৬২ দিন পর জামিন পেয়ে কারামুক্ত হন আদিলুর রহমান খান।
পুলিশের অভিযোগে বলা হয়েছে, এই দুই মানবাধিকারকর্মী ৬১ জনের মৃত্যুর বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার করে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি করেন, আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করার চেষ্টা করেন এবং দেশে-বিদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ করেন।
রায়ের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড়
আদিলুর রহমান খান ও নাসির উদ্দিনকে সাজা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস এক বিবৃতিতে বলে, “মানুষের অধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রচার ও সুরক্ষায় মানবাধিকারকর্মী এবং সুশীল সমাজের সংগঠনগুলোর কার্যক্রমকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে যুক্তরাষ্ট্র।”
“ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান এবং পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলানের বিরুদ্ধে আজকের রায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং মনে করছে, এটি মানবাধিকারকর্মী ও সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক ভূমিকা পালনের সদিচ্ছাকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে,” বলা হয় বিবৃতিতে।
অধিকার কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন তৈরি করেছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, “গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ হিসেবে আমরা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং প্রাণবন্ত নাগরিক সমাজকে অব্যাহতভাবে সমর্থন করি এবং মৌলিক অধিকার নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করি।”
এছাড়া এক যৌথ বিবৃতিতে ৭২টি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এই দুই মানবাধিকারকর্মীর সাজা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সেই সঙ্গে আদিলুর রহমান খান ও এলানের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানায়।
ইইউ পার্লামেন্টের উদ্বেগ
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বুধবার রাতে একটি যৌথ রেজুলেশন গ্রহণ করেছে।
এতে বাংলাদেশ সরকারকে এনজিও, মানবাধিকার রক্ষাকারী, রাজনৈতিককর্মী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য একটি নিরাপদ ও সক্ষম পরিবেশ পুনরুদ্ধারের এবং দেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার; বিশেষ করে বেসামরিক চুক্তির অধীনে আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশে বিরোধী প্রতিনিধিদের গণগ্রেপ্তারের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, ২০২৪ সালে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচনের শর্ত নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানানো হয়।
পাশাপাশি অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে অধিকারের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রত্যাহার এবং সংগঠনটির নিবন্ধন ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশ সরকারকে আহ্বান জানানো হয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, “এই প্রস্তাবের বিষয়ে ইইউতে আলোচনা আইনত বাধ্যতামূলক নয়।”
একই সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, “এটা হস্তক্ষেপ।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো অপপ্রচার হলে আমরা বসে থাকব না।”