ভারতের পণ্য পরিবহনে স্থায়ীভাবে সমুদ্র বন্দর খুলে দিলো বাংলাদেশ

রিয়াদ হোসেন
2023.04.27
ঢাকা
ভারতের পণ্য পরিবহনে স্থায়ীভাবে সমুদ্র বন্দর খুলে দিলো বাংলাদেশ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের জেটি। ২৯ নভেম্বর ২০২১।
[বেনারনিউজ]

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দরকে ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্ট হিসেবে ব্যবহারের জন্য স্থায়ী আদেশ জারি করেছে বাংলাদেশ।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) জারি করা ২৪ এপ্রিলের ওই আদেশে দুটি বন্দর থেকে দেশটির পণ্য পরিবহনে আটটি রুট ছাড়াও বিভিন্ন চার্জ ও ফি ঠিক করা হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র (এফবিসিসিআই) সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বেনারকে বলেন, “এর ফলে উভয় দেশের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হবে।”

এতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কোনো ক্ষতি নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ভারত তাদের পণ্য বাংলাদেশর বন্দর ব্যবহার করে তাদের সাতটি রাজ্যে পাঠাতে পারবে। এতে তাদের সময় ও ব্যয় কমবে।”

বাংলাদেশের অর্থনীতিও উপকৃত হবে জানিয়ে তিনি বলেন, “এখানকার এজেন্ট (সিএন্ডএফ এজেন্ট) ও সরকার বিভিন্ন ফি এবং ভ্যাট পাবে। আবার বন্দরের ব্যবহারও বাড়বে।”

অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরও বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। বেনারকে তিনি বলেন, “আমরা (বাংলাদেশ) এতদিন ধরে আঞ্চলিক বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দেইনি। এখন তা শুরু হলো।”

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, “এতে ভারতের পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে সময় ও ব্যয় উভয়ই কমবে। আর আমাদের বন্দর ও কাস্টমস বিভিন্ন ধরনের চার্জ আদায় করবে – তাতে অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদে কিছুটা হলেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।”

চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য সরবরাহ করতে দুই দেশের মধ্যে ২০১৮ সালের অক্টোবরে চুক্তি হয়েছিল যার নাম “এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম এন্ড মোংলা পোর্টস ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু এন্ড ফ্রম ইন্ডিয়া।”

ওই চুক্তির পর এ কার্যক্রম নিয়ে উভয় দেশ স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা এসওপি চূড়ান্ত করে। তবে শুল্কায়ন কার্যক্রম কীভাবে সম্পন্ন করা হবে কিংবা পণ্যচালান কী প্রক্রিয়া আনা-নেওয়া হবে, তা চূড়ান্ত না হওয়ায় এ ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রম পুরোদমে চালু করা যায়নি।

এর মধ্যে গত বছরের আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে ভারতীয় পণ্যের চালান বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে আসাম ও মেঘালয়ে নেওয়া হয়।

আদেশে যা বলা হয়েছে

এনবিআর সদস্য (কাস্টমস নিরীক্ষা, আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য) ড. আব্দুল মান্নান শিকদার স্বাক্ষরিত ওই আদেশে বলা হয়, “বাংলাদেশে প্রচলিত আইন ও বিধান অনুসারে আমদানি নিয়ন্ত্রিত পণ্য ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট করা যাবে না।”

অবশ্য এ আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করলেও বিস্তারিত কিছু জানাতে রাজি হননি তিনি।

আদেশের একটি কপি বেনারের হাতে এসেছে। ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট পণ্যের মেয়াদ সাত দিন উল্লেখ করে ওই আদেশে বলা হয়, “সাত দিনের মধ্যে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সম্পন্ন না হলে বা অন্য কারণে প্রস্থান বন্দরে না পৌঁছালে বা অবৈধভাবে বাংলাদেশের মধ্যে অনুপ্রবেশ করলে উক্ত পণ্যের উপর শুল্ক-কর, অর্থদণ্ড ও জরিমানা পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে।”

এছাড়া ট্রানজিট পণ্যে ইলেক্ট্রনিক সিল ও তালা ব্যবহার করার শর্তও যুক্ত করা হয়েছে।

দুই বন্দর ব্যবহার করে আটটি পথে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের কার্যক্রম সম্পাদন করা যাবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে। ভারতের বন্দরগুলো থেকেও ফিরতি পথে একই রুট ব্যবহার হবে।

বাংলাদেশ যা পাচ্ছে

নতুন আদেশ অনুযায়ী, ট্রান্সশিপমেন্ট ফি প্রতি মেট্রিক টনের জন্য ২০ টাকা। এছাড়া ডকুমেন্ট প্রক্রিয়াকরণ ফি প্রতি চালানোর জন্য ৩০ টাকা, সিকিউরিটি চার্জ প্রতি টন ১০০ টাকা, এসকর্ট চার্জ প্রতি কন্টেইনার বা ট্রাক ৮৫ টাকা, বিবিধ প্রশাসনিক চার্জ ১০০ টাকা।

এ ছাড়া ই-সিল ও লক চার্জ এখনো সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। আর টোলসহ সড়ক ব্যবহার মাশুল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব চার্জের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট প্রযোজ্য হবে।

এ আদেশের সঙ্গে যুক্ত এনবিআরের কাস্টমস বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, “নতুন করে এসকর্ট ফি ও ভ্যাট যুক্ত হয়েছে।”

এছাড়া বর্তমানে মোংলা বন্দর প্রায় অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এই বন্দরের ব্যবহারও বাড়ার সুযোগ তৈরি হবে।

ফি ও চার্জ পর্যালোচনা করার পরামর্শ

বাংলাদেশ ও ভারতের সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর দীর্ঘ আলোচনার পর ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট এর ফি নির্ধারণ করা হয়েছে, যদিও এটি নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন উঠেছে।

এসব ফি পর্যালোচনা করা উচিত বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। বেনারকে তিনি বলেন, “আমি কম বা বেশি বলতে চাই না। অন্যান্য দেশগুলো ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে কী ধরনের ফি আদায় করে, তার ভিত্তিতে আমাদের দেশে এই হার পর্যালোচনা করা যেতে পারে। এর সঙ্গে ডলারের দরের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা উচিত।”

নেপাল-ভুটানের সঙ্গে একই ট্রানজিট সুবিধা দাবি

বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বাংলাবান্ধা থেকে নেপালের কাকরভিটা পর্যন্ত পণ্য আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে একই সুবিধা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, “পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা হয়ে নেপালের কাকরভিটা পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার সড়ক ভারত স্থায়ীভাবে ব্যবহার করতে দেয় না। এই সড়ক স্থায়ীভাবে ব্যবহার করার সুযোগ পেলে নেপাল ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য বাড়বে।”

বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর মূলত নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়টিকে মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা আহ্বান জানাই, যাতে কাকরভিটা পর্যন্ত ভারতের অংশের সড়কটি বাংলাদেশি পণ্য নেপাল-ভুটানে পরিবহনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।”

দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেপালে বাংলাদেশের আলু, বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য, কোমল পানীয়, শুকনো খাবার যেমন: চানাচুর, বিস্কুট, ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।